প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫, ৬:৪৮ পিএম

# প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা চায় ঢাকা কাস্টমস হাউস
# এআই-চালিত প্রযুক্তি চালুসহ যুগান্তকারী উদ্যোগ
# বিমানবন্দরের সমস্যারোধে গত তিন মাস গবেষণা
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা এবং চোরাচালান রোধে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আধুনিক প্রযুক্তির যুগান্তকারী সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। বিমানবন্দরে বসানো হবে এআই-চালিত হিউম্যান স্ক্যানার, অত্যাধুনিক ভেহিক্যাল ও বেল্ট স্ক্যানারসহ একাধিক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে স্বর্ণ ও অন্যান্য অবৈধ পণ্যের চোরাচালান কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে গত তিন মাস ধরে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার শক্তি, দুর্বলতা, সমস্যা এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে একটি গভীর গবেষণা চালায় কাস্টমস হাউস। গবেষণার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস এবং দেশের বাস্তবতা মিলিয়ে একটি সুপরিকল্পিত প্রস্তাবনা তৈরি করে এনবিআরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা বন্দরের দুর্বলতা চিহ্নিত করে বাস্তবভিত্তিক সমাধান খুঁজেছি। সেই অনুসারে একটি প্রস্তাবনা এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন মিললে দ্রুত বাস্তবায়নে যাবো।’
ঢাকা কাস্টমস হাউসের প্রস্তাবনাগুলো হলো-
১. এয়ারসাইডে বেল্টের শুরুতে স্ক্যানার স্থাপন: আন্তর্জাতিক মান অনুসরণে, টার্মিনাল ১ ও ২-এ বিদ্যমান ল্যান্ডসাইড স্ক্যানারের পরিবর্তে ব্যাগেজ বেল্টের শুরুতে, অর্থাৎ এয়ারসাইডে স্ক্যানার স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নকশা ও বিশ্লেষণ শেষে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ-এর অনুমোদন/অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়।
২. ডাইভার্টিং বেল্টের পরিবর্তে আরএফআইডি সিস্টেম: স্ক্যানিং শেষে সন্দেহজনক ব্যাগ কাস্টমস হলে নিয়ে আসার জন্য প্রচলিত ডাইভার্টিং বেল্টের ব্যবস্থাটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল-৩-সহ কোথাও পরিকল্পনায় রাখা হয়নি, যা একটি বড় নকশাগত ত্রুটি। বিকল্প হিসেবে আরএফআইডি সিস্টেম চালুর প্রস্তাব রয়েছে। এতে স্ক্যানিং শেষে সন্দেহজনক ব্যাগে আরএফআইডি লক লাগানো হবে, এবং যাত্রীরা কাস্টমস হল অতিক্রমের সময় আরএফআইডি গেট সেই ব্যাগগুলো শনাক্ত করবে। টার্মিনাল ১, ২ ও ৩-এ এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ আরএফআইডি ব্যবস্থা ও গেট স্থাপন করতে হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হবে।
৩. হিউম্যান বডি স্ক্যানার স্থাপন: ব্যাগেজ শতভাগ স্ক্যানিং কার্যকর হলে অবৈধ পণ্যের বহন দেহ বা হাতব্যাগের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে। বিশেষত স্বর্ণ ও মূল্যবান পণ্য চোরাচালান প্রতিরোধে হিউম্যান বডি স্ক্যানার কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এজন্য বিদ্যমান ও নতুন টার্মিনালে ১০টি স্ক্যানার স্থাপন জরুরি। এর মধ্যে টার্মিনাল ১ ও ২-এর গ্রিন চ্যানেল ১ ও ২-তে ৪টি, ভিআইপি গেটে ১টি এবং টার্মিনাল-৩-এ সমসংখ্যক ৫টি স্ক্যানার স্থাপন প্রয়োজন।
৪. এপিআই (অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন) সিস্টেম বাস্তবায়ন: ঝুঁকিভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সেবার মান বৃদ্ধি ও সম্পদের অপচয় রোধ করা যায়। অধিকাংশ দেশ আগাম যাত্রী তথ্য ব্যবহার করে যাত্রীঘনিষ্ঠ অপরাধ চিহ্নিত করে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এপিআই সিস্টেম চালুর লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রেখে দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারে। কাস্টমস হাউজ ঢাকা থেকে পুরো কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এনবিআর সরাসরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে।
৫. এআই-ভিত্তিক ফেসিয়াল রিকগনিশন ক্যামেরা (এফআরসি) সংযুক্ত সিসিটিভি স্থাপন: বর্তমানে টার্মিনাল ১ ও ২-এ একসঙ্গে ৮টি প্লেন অবতরণ করলে প্রায় ৪ হাজার যাত্রী নামে। পিক আওয়ারে ২-৩ হাজার যাত্রী একত্রে আগমন করে, কিন্তু কাস্টমস হলে একত্রে প্রবেশ করতে পারে মাত্র ২-৩ শত যাত্রী। টার্মিনাল-৩-এ একই সময়ে ১৬টি প্লেন থেকে ৮ হাজার যাত্রী নামবে, যেখানে হলে প্রবেশ করতে পারবে সর্বোচ্চ ২০০-২৫০ জন। এ পরিস্থিতিতে অধিক যাত্রী চেক করা গেলে সেবার মান কমে, আবার কম চেকিংয়ে চোরাচালান বাড়ে। ফলে সীমিত জনবল দিয়ে সীমিত আকারে তল্লাশি চালানো ছাড়া উপায় থাকে না। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় এআই-চালিত ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে নিয়মিত যাত্রী ও সন্দেহভাজনদের দ্রুত শনাক্ত করে কর্মকর্তাকে সতর্ক বার্তা পাঠানো যাবে। এটি উন্নত বিশ্বের বিমানবন্দরে বহুল ব্যবহৃত ব্যবস্থা। সম্প্রতি কাস্টমস হাউজ, ঢাকা কোডে কিছু বরাদ্দ এসেছে, যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে সীমিত পরিসরে সিস্টেমটি স্থাপন শুরু হচ্ছে।
৬. ক্যাটারিং গেট ও ৮নং গেটে ভেহিক্যাল স্ক্যানার স্থাপন: বিমান ক্যাটারিং সার্ভিস এলাকায় কাস্টমস উপস্থিত না থাকলেও অতীতে স্বর্ণ পাচারের নজির রয়েছে। তাই খাবার ও উচ্ছিষ্ট বহনের গাড়ির স্ক্যানের জন্য সেখানে একটি ভেহিক্যাল স্ক্যানার জরুরি। একইভাবে ৮নং গেট, যা দিয়ে সব গাড়ি বিমানবন্দরে প্রবেশ ও প্রস্থান করে, সেখানেও একটি স্ক্যানার বসানো প্রয়োজন, কারণ ম্যানুয়াল চেকিং তেমন কার্যকর নয়। তাই এই দুই গেটে মোট দুটি ভেহিক্যাল স্ক্যানার স্থাপন করা আবশ্যক।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে বিমানবন্দরে চোরাচালান কার্যক্রম প্রায় শূন্যে নেমে আসবে, পাশাপাশি বর্তমান নিরাপত্তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কার্যকর হবে ভবিষ্যতের নিরাপত্তাব্যবস্থা।
কেকে/ এমএস