আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এর তিন দিনের মাথায় ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পায় দেশ। আর ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। মোট তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেলেও এখনো বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
এদিকে ঋণের বাকি অর্থ পাওয়া নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ। আইএমএফ-এর পক্ষে আগেই জুড়ে দেওয়া হয় নানা শর্ত। ঋণের কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশ মুদ্রা বিনিময় হার নমনীয় করবে কি না, তার ওপর।
আর দেশের মুদ্রা বিনিময় নমনীয় করার অর্থ হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে মুদ্রা টাকার মান কত হবে, তা ঠিক হবে বাজারে। অর্থাৎ মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনোই তা ছেড়ে দিতে চায় না।
এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে গত সোমবার রাতে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেও এ নিয়ে সমঝোতা হয়নি। আইএমএফের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান ও কবির আহমেদ।
এক সূত্রে জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। তবে বাংলাদেশের আলোচনার পথও বন্ধ হয়নি। সমঝোতা নিয়ে আরো বৈঠক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আইএমএফকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই নয়।
যদিও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক, বিষয়টি আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্তেও ছিল। গত মাসে আইএমএফ কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরে এ নিয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে গত মাসের এক বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন কোনো পক্ষই সমঝোতায় পৌঁছায়নি। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হলে মুদ্রা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলারের দাম আরো বেড়ে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি, তখন এটি আরো বেড়ে যেতে পারে।
সোমবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত আইএমএফের বৈঠকে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির বাইরে আরো ১০০ কোটি ডলারের একটি স্থিতিশীলতা তহবিল (স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড) চাওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আইএমএফকে বলা হয় বিনিময় হার নমনীয় করলে সম্ভাব্য যেসব সমস্যা হতে পারে, তা মোকাবিলা করা হবে এ তহবিল থেকে। ডলারের দাম বাড়তে থাকলে ওই তহবিল থেকে মুদ্রা সরবরাহ করে বাজার স্থিতিশীল করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে রিজার্ভে হাত না দিতে হয়। এসব বিষয়ে আপাতত কোনো সমঝোতায় আসেনি সংস্থাটি।
আইএমএফের ঋণ নিয়ে ধোঁয়াশা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশ সরে দাঁড়াবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়ার কথা আছে। কিন্তু আইএমএফের সঙ্গে শর্ত পালন নিয়ে দরকষাকষি চলছে, তবে এখনো সমঝোতা হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দরকষাকষি চললেও মূলত একটি শর্ত পরিপালনের ওপর চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় নির্ভর করছে। সেটি হলো বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অনেকটা বেঁধে দেওয়া মুদ্রা বিনিময়হার কার্যকর আছে।
এ ছাড়া কৃষি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার, এসব শর্তও আছে। অবশ্য এসব শর্ত ধাপে ধাপে পূরণ করছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত সোমবার সন্ধ্যায় ভার্চুয়াল উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে কোনো সমঝোতা হয়নি; আরও আলোচনা চলবে।
উন্মুক্ত বিনিময় হার নিয়েই যত ঝামেলা
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখায় ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। আড়াই বছরে মার্কিন এ মুদ্রার দাম এ সময়ে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে।
গত ডিসেম্বর মাসে ডলারের নির্দিষ্ট দাম ধরে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত উঠানামার একটি সীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন বলা হয়, ১২৩ টাকা পর্যন্ত ডলার লেনদেন করা যাবে। এখন ১২২ থেকে ১২৩ টাকা দরে ডলার বেচাকেনা করছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আইএমএফ এখন বলছে, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বাজারই নির্ধারণ করবে ডলারসহ বিদেশি মুদ্রার দাম কত হবে। বাংলাদেশ তাতে রাজি নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রা বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া কঠিন। পুরোপুরি বাজারনির্ভর বিনিময়হার ব্যবস্থা চালু হলে যে কোনো সময় অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসতে পারে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে ডলারের পড়তি দাম বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমছে। ৩ বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের বেশি ছিল। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এখন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে না দিলে আর কখন করা হবে? কারণ, এখন লেনদেনের ভারসাম্য ভালো আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে দাম কমেছে, অন্যান্য পণ্যের দামও পড়তি। আমদানি চাহিদাও কম, তাই চাপ আসার শঙ্কা কম।
ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আইএমএফের মিশন শেষ হয়। তখন শর্তের বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন সভায় অংশ নিতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবার বৈঠক করেন। বিনিময়হার উন্মুক্ত করার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায় ওই বৈঠকে।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার আইএমএফের কাছ থেকে ছোট-বড় ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সর্বশেষ নেওয়া বর্ধিত ঋণ-সহায়তার (ইসিএফ) ১০০ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। সব কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এর আগে কোনো ঋণ কর্মসূচিই পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সহায়তা (পিআরজিএফ) কর্মসূচিতে ৪৯ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাক্সিক্ষত সংস্কার না হওয়ায় তিন কিস্তি পাওয়ার পর বাকি তিন কিস্তি স্থগিত করেছিল আইএমএফ।
কেকে/ এমএস