বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। উপকূলের লবণাক্ততা, নদীভাঙন, খরা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা-সব মিলিয়ে জলবায়ু বিপর্যয় এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সহায়তায় গঠিত ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ (ইঈঈঞঋ) হওয়ার কথা ছিল আমাদের ভবিষৎ নিরাপত্তার একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে তা আমাদের আশা ও ভরসাকে উদ্বেগময়তা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করছে।
ট্রাস্টফান্ডকে ঘিরে সীমাহীন দুর্নীতি আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে অনিরাপদ দেশ উপহার দিতে যাচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জলবায়ু তহবিল থেকে ২,১১০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দুর্নীতি ও অপচয়ে নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা ও তদারকির অভাবে প্রকল্পগুলো রীতিমতো ব্যক্তিস্বার্থের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো- তহবিলের ৫৪ শতাংশ প্রকল্পই দুর্নীতির জালে জড়িত। যে অর্থ দিয়ে নদীর তীর রক্ষা, কৃষিজমি টেকসই করা বা জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ করা যেত, তা চলে গেছে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির পকেটে। প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের ভয়াবহ চিত্র। গড়ে ৬৪৮ দিনের কাজ শেষ হতে লেগেছে ১,৫১৫ দিনÑঅর্থাৎ সময় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। অনেক প্রকল্প ৪ বছর মেয়াদি হলেও শেষ হতে লেগেছে ১৪ বছর পর্যন্ত। ফলে জনগণের টাকা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিপর্যয়ের মুখে থাকা মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই তহবিল থেকে অপ্রাসঙ্গিক প্রকল্পে ব্যয় করা, যেমন সাফারি পার্ক বা ইকো পার্ক নির্মাণ- যার সঙ্গে জলবায়ু অভিযোজনের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। এতে বোঝা যায়, জলবায়ু অর্থায়নকে কেবল ‘সহজ অর্থের উৎস’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, পরিবেশ নীতির অংশ হিসেবে নয়। অন্যদিকে, প্রতিবছর যেখানে জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন প্রায় ১২,৫০০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে বরাদ্দ আসছে মাত্র ৮৬ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রয়োজনের ১ শতাংশেরও কম। জাতীয় বরাদ্দও কমছে প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে। এ বৈষম্য ও দুর্নীতি মিলেই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আস্থাহীনতার পথে ঠেলে দিচ্ছে। টিআইবি যথার্থভাবেই বলেছে- এটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক ও প্রজন্মগত অপরাধও।
জলবায়ু তহবিলের অর্থ হলো আগামী প্রজন্মের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। সেই অর্থ আত্মসাৎ মানে ভবিষ্যৎকে বিক্রি করে দেওয়া। ফলে এই সংকট মোকাবিলা এই মুহূর্তে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০ সংশোধন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, স্বাধীন তদারকি সংস্থা গঠন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রবর্তন, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দেওয়া স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নের নীতি যদি ‘উন্নয়ন’ নয় বরং ‘দুর্নীতি’র আরেক অধ্যায়ে পরিণত হয়, তবে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহায়তাও হুমকির মুখে পড়বে। উন্নয়ন নয়, এটি হবে আত্মবিনাশের উন্মুক্ত রাস্তা। জলবায়ুর লড়াই আসলে নৈতিকতার লড়াইও। এ তহবিল যদি লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা না হয়, তবে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির নয়, নৈতিকভাবেও দেউলিয়াত্বের দিকেও এগিয়ে যাবে।
কেকে/এআর