নির্মম হত্যা-গণহত্যার ঘটনায় এখন সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে। গৃহযুদ্ধ আসলে কতটা ভয়াবহ হতে পারে সে উদাহরণ পৃথিবীতে অনেক আছে। কয়েক যুগ ধরে বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ চলেছে। গৃহযুদ্ধ মূলত একটি দেশের মধ্যেকার দুই বা দুইয়ের অধিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা মহলকে বহিঃরাষ্ট্রের সমর্থন দিতে পারে আবার নাও পারে। সুদান সম্ভবত এর সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হতে যাচ্ছে। ক্ষমতার লড়াই আর নড়বড়ে শাসনব্যবস্থা সুদানকে কার্যত একটি অচল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এখন সেখানে শুধু রক্ত আর রক্ত। বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে সুদানের সাধারণ মানুষের হাহাকার। দারফুর অঞ্চলে নতুন করে গণহত্যা চালাচ্ছে বিদ্রোহী আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। শহর দখলের পর ঘরে ঘরে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তারা। মানবাধিকার বিশ্লেষকরা বলছেন, মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান এ রক্তাক্ত পরিস্থিতি ২০ বছর আগে শুরু হওয়া দারফুর গণহত্যার চূড়ান্ত অধ্যায়কে সামনে এনেছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব (এইচআরএল) জানিয়েছে, স্যাটেলাইট চিত্রে শহরের বিভিন্ন স্থানে দেহসদৃশ অসংখ্য বস্তু দেখা গেছে, যেগুলোর চারপাশে রক্তের দাগ স্পষ্ট। এসব দেহ শনাক্ত হয়েছে হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা, শহরের উপকণ্ঠ এবং সরকারি সেনা ঘাঁটির কাছাকাছি। এইচআরএলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আরএসএফ এখন শহরের সেনা ঘাঁটিগুলোও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ২৬ অক্টোবরের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, সুদানি সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ ডিভিশনের ঘাঁটিতে অন্তত ১৫টি নতুন বিস্ফোরণ ও পোড়া দাগ রয়েছে, যা আগের (১৫ অক্টোবরের) ছবিতে ছিল না। দুঃখজনক ব্যাপার হলো সুদানের এ ঘটনায় টার্গেট করা হচ্ছে সাধারণ মানুষ যারা মূলত পালিয়ে বাঁচতে চায়। ১৮ মাস ধরে অবরোধের পর গত রোববার আরএসএফের হাতে আল-ফাশার শহরটির পতন হয়। এর আগে উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী আল-ফাশার ছিল সুদানের সেনাবাহিনীর শেষ শক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটি থেকে সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে আরএসএফ এবং সেইসঙ্গে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
সুদান পৃথিবীর মানচিত্রে উত্তর আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। সুদানের রাজধানীর নাম খার্তুম। আয়তনের দিক থেকে আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্র হলো সুদান। সেই সুদানেই এখন আগুন জ্বলছে। সেখানে সেনাবাহিনী ও আরএসএফ যারা ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছিল এ বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। সেনাবাহিনী কোথাও কোথাও অবস্থান ছেড়ে গেছে এবং আরএসএফ নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। শহরগুলো ক্রমেই সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এ যুদ্ধে অন্তত কয়েক শত মানুষের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সুদানে দুবছরের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ।
২০২৩ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘাত শুরুর পর থেকে দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এ মুহূর্তে সুদানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট চলছে। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, গৃহহীন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেশজুড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পালাচ্ছে। একটি সম্ভাবনাময় দেশকে দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে রেখে আজকের সুদানে পরিণত করা হয়েছে। এর দায় সেখানকার শাসকেরা অস্বীকার করতে পারে না। ক্ষমতাই সেখানে ছিল মুখ্য বিষয়। জনগণ কি চেয়েছে বা উন্নয়নের মূল চাবিকাঠির ধারেকাছেই যেতে পারেনি শাসকবর্গ। বর্তমানে দুই বাহিনীর কর্তৃত্ববাদী মনোভাবই এর কারণ। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে না গিয়ে অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসার এ ভয়ংকর রাস্তায় বারবার হেঁটেছে তারা। পৃথিবীজুড়েই এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জের চলছে।
সুদানে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এরপর থেকে দেশটি জেনারেলদের একটি কাউন্সিল পরিচালনা করে আসছে। তবে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল আল-বুরহান এবং দেশটির উপনেতা জেনারেল হামদান দাগালো কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার যিনি হেমেডটি নামেই বেশি পরিচিত। প্রেসিডেন্ট বশিরই এ বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করেন।
মোট কথা আজকের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি এ বাহিনী তৈরির দায় প্রেসিডেন্ট বশিরেরই। এ দুটি বাহিনীর হাতেই অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর দখলে, আর পশ্চিম ও দক্ষিণের বড় অংশ বিশেষ করে দারফুর ও কোর্দোফান অঞ্চল আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। রাজধানী খার্তুম দুপক্ষের লড়াইয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আরএসএফের কাছে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য উদ্ধৃত করে এ খবর প্রকাশ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ধারণা করা হচ্ছে- আমিরাতের পাঠানো এসব অস্ত্র দিয়েই সুদানে গণহত্যা চালানো হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও জানিয়েছে, ইউএই আরএসএফকে বোমা ও হাউইটজার কামান পাঠাচ্ছে। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে চীনা তৈরি ড্রোন, হালকা অস্ত্র, ভারী মেশিনগান, কামান, মর্টার ও গোলাবারুদ। আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে ‘হেমেদতি’ ইউএইএর ঘনিষ্ঠ মিত্র। তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কেন্দ্র দুবাইয়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সত্যি হলে হতে পারে সেই সূত্রে আরব আমিরাত অস্ত্র দিয়ে থাকতে পারে।
২০১২ সালে মালি এবং এরপর মিসর, বুরকিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, সুদান, মালি, চাদ, গিনি এবং ২০২১ সালে ফের সুদানেই সেনা অভুত্থান ঘটে। ১৯৬৭ সালের পর থেকে সুদানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে ১৫টি। বিশ্বব্যাপী নিন্দা বা গণতন্ত্র ফেরতের দাবি থাকলেও সহসাই সে ধারা ফেরে না। ফলে বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক পরিবেশ অস্থিরতায় বিরাজ করে। আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব আফ্রিকার রাষ্ট্র সুদান এখন উত্তাল। অন্তর্দন্দ্ববহুল এ দেশটি গত কয়েকদিন ধরেই বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে। সুদান মাঝে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকলেও দেশটি এখন অস্থিতিশীল। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মিসরীয়রা দাবি করতে থাকে, মিসর ও সুদান এক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় না। ১৯৫৪ সালে মিসরীয়ার ব্রিটিশদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটিতে গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশটিতে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলে স্বাধীনতার পরপরই একজন সামরিক কর্মকর্তা দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭২ সালে এক চুক্তিতে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের অবসান হলেও ১৯৮৩ সালে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৮৯ সালের ৩০ জুন কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটান। এরপর তিনি শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। তিনি দেশটিতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামি আইন চালু করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিজেকে সুদানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন এবং এরপর এক নির্বাচনে তিনি নিজেই প্রার্থী হন। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুসারে চুক্তির পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চল স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য ছয় বছর পর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। আন্তজাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালে নির্বাচনে তিনি জয় পান।
২০১৫ সালের নির্বাচনবিরোধীরা বর্জন করেন। এই ওমর আল বশিরকে ২০১৯ সালে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওমর আল বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরাতে এখনকার বিরোধী দুজন একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। এ বাহিনী প্রধান দাগালোই ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে ঐকমত্য না হওয়ায় ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ওমর আল বশির ক্ষমতাচ্যুত হন। রুটির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে তার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিন দশক পর সুদানে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারপর থেকে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য সংকট বাড়তে থাকে।
এ ঘটনার পর থেকেই সামরিক বাহিনী ও বেরসকারি নেতৃত্বের মধ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অথচ সুদানের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এবং অধিকাংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য হলো তেল। সুদানের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময়ই একটি অস্থিতিশীলতার মধ্যে পার করেছে। সামরিক শাসনও সেখানে ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায়। জাতিসংঘের উচিত দ্রুত সেখানে শান্তি ফেরাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আফ্রিকান ইউনিয়নেরও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সেক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন থাকলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই তীব্র চাপ মোকাবিলা করতে হবে। আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, সুদানের এ অন্তর্সংঘাত অল্প সময়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে। আলোচনা এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ফেরাতে উভয় পক্ষেরই নিজ দেশে সংঘাত বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। নিরীহ মানুষকে হত্যার পথ থেকে সরে আসতে হবে। এ ছাড়া সুদান আফ্রিকায় একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর ফলে সুদানের মানবিক বিপর্যয় যা ইতোমধ্যেই ঘটছে এবং এ পরিস্থিতি আরো বিরূপ হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কেকে/এআর