আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য, বিকৃত প্রচারণা ও বিদ্বেষমূলক কনটেন্টের বিস্তার এক ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছে। নির্বাচনের আগে যেভাবে মিথ্যা পোস্ট, মনগড়া ভিডিও ও এআইনির্ভর বিকৃত কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে- তা কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জনআস্থার ওপর সরাসরি আঘাত।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সাংবাদিক, রাজনীতিক ও নাগরিক কর্মীদের ব্যক্তিগত সামাজিকমাধ্যম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ভুয়া তথ্য প্রচারের ঘটনা বেড়েছে। এসব আক্রমণ শুধু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে না; বরং জনমত প্রভাবিত ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিপথগামী করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু প্রার্থীদের লক্ষ্য করে তৈরি হচ্ছে বিকৃত ছবি, মিথ্যা বক্তব্য ও কৃত্রিম ভিডিও, যা তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
সমস্যার গভীরতা বোঝা গেলেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি উদ্বেগজনকভাবে দুর্বল। ১৭ কোটি মানুষের দেশে কার্যকর ফ্যাক্ট-চেকার মাত্র কয়েক ডজন। বেশিরভাগ মূলধারার গণমাধ্যমে স্বতন্ত্র তথ্য-যাচাই ইউনিট নেই। সাংবাদিক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের ঘাটতিতে ভুগছেন। এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
এ অবস্থায় ‘ডিজিটালি রাইট’-এর সাম্প্রতিক গবেষণা যথার্থভাবেই সতর্কবার্তা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশের ডিজিটাল তথ্যপরিবেশ এখন ভীষণ ভঙ্গুর ও বিভক্ত। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও প্রবাসী প্রভাব বিস্তারকারীরা সবাই যেন ‘ডিজিটাল প্রতিযোগিতায়’ নেমেছে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা প্রায় বিলীন।
তাই এখনই সরকার, গণমাধ্যম, প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে অপতথ্যের এই সুনামি নির্বাচনি আস্থা, শান্তি ও গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলাÑসবকিছুকেই বিপন্ন করে তুলবে। পাশাপাশি নতুন ডিজিটাল বিধিমালা যেন ভিন্নমত দমন বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার অস্ত্র না হয়, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে।
গণমাধ্যমকে এখন প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য-যাচাই ব্যবস্থার দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। সামাজিকমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে জবাবদিহিমূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। আর সরকারকে অবিলম্বে অংশীজনদের নিয়ে আলোচনায় বসে নির্বাচনি তথ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের একটি সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ নীতিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
নির্বাচন শুধু ভোটের দিন নয়, বরং তথ্যযুদ্ধেরও একটি পরীক্ষা। সত্য, স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সমন্বয়ই পারে এই যুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করতে। এখনই সময় অপতথ্যের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিরোধ গড়ার।
কেকে/এআর