নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চল থেকে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটজন গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা শুধু এক জেলার খবর নয়। এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র, আধিপত্য বিস্তার ও সশস্ত্র সংঘর্ষের ক্রমবর্ধমান একটি আলামত মাত্র। নরসিংদীতে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলোর একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে নদীপথে প্রবেশ করেছে, অন্য অংশ কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবৈধ কারিগররা তৈরি করেছে। এই ধরনের অস্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহ দক্ষিণ ও উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনিয়মিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং একটি নিরাপত্তাহীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
চরাঞ্চল সবসময়ই প্রশাসনিকভাবে অরক্ষিত। নদীপথ, বালুমহাল, চর, ঘাট ও বাজার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এলাকায় গ্রুপ সংঘর্ষ দীর্ঘদিনের ঘটনা। গত কয়েক মাসে রায়পুরার চরাঞ্চলে একাধিক সংঘর্ষে মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকাতেও ছোট অস্ত্র তৈরির কারখানা চলছে। এসব অবৈধ অস্ত্র চক্র স্থানীয় সন্ত্রাসী, দখলদার ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে।
দেশের ৭টি রুট দিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালানও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে তৈরি বন্দুক, রিভলভার ও পিস্তল পাচারের খবর নিয়মিত পাওয়া যায়। নদীপথে ছোট নৌযান দিয়ে এই অস্ত্র বাংলাদেশে ঢুকছে। বিজিবি ও র্যাবের অভিযান থাকলেও নদীপথ ও চরাঞ্চলের জটিল ভূগোল এই চক্রকে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রাম বিভাগে গত দুই বছরে ৬০০টির বেশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। দেশে মোট উদ্ধার হয়েছে ১,৫০০টির বেশি, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা ও ভয় প্রদর্শন। এ কারণে শুধু অভিযান চালানো যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সারাদেশে সমন্বিত পদক্ষেপ। নদীপথে ডিজিটাল নজরদারি, রাডারভিত্তিক ট্র্যাকিং ও স্থায়ী টহল বাড়ানো জরুরি। সীমান্ত এলাকায় যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক চক্রের অর্থনৈতিক উৎস শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। চরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় প্রশাসনের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
যতদিন রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থের ছত্রছায়ায় এই অস্ত্র সংস্কৃতি টিকে থাকবে, ততদিন সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। রায়পুরার অভিযান প্রশংসনীয়, কিন্তু এটি যেন বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে সীমাবদ্ধ না থাকে। সময় এসেছে একটি জাতীয় পরিকল্পিত অভিযান চালানোর- যেখানে লক্ষ্য শুধু অস্ত্র উদ্ধার নয়, বরং এর উৎস, রুট ও অর্থনীতিকে সমূলে নির্মূল করে।
অন্যথায়, আজকের রায়পুরা, আগামী দিনের রাজশাহী বা বরগুনা হতে সময় লাগবে না। এই অস্ত্র চক্র কেবল স্থানীয় আধিপত্য নয়, দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নদীপথ থেকে সীমান্ত, চর থেকে পাহাড়- সারা দেশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করা গেলে দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ব্যাহত হবে। দেশের মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
কেকে/এআর