দেশে ক্রমশই বেড়ে চলছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল কোনো রোগ নয়, এটি রূপান্তরিত হয়েছে বছরব্যাপী জনস্বাস্থ্য সংকটে। এক সময় কেবল বর্ষাকালেই সীমাবদ্ধ থাকা ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন অক্টোবর-নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও বিস্তার লাভ করতে পারে বলে ধারণা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ বছরের ডেঙ্গুর সামগ্রিক পরিস্থিতি জটিল এবং একই সঙ্গে উদ্বেগজনক। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। এই চারজন নিয়ে এ বছর মৃত্যু সংখ্যা ২৯২ জন অর্থাৎ তিনশ’ ছুঁই ছুঁই আর গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ১১০১ জন আক্রান্ত হয়েছেন আর সবমিলিয়ে সারাদেশে এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯২৩ জন। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ডেঙ্গুর চিত্র দেখে ধারণা করা হচ্ছিল সব থেকে বেশি আক্রান্তের মাস বুঝি বা সেপ্টেম্বর (১৫ হাজার ৮৬৬ জন)। তবে অক্টোবরে রোগীর সংখ্যা সেপ্টেম্বরকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত অক্টোবরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৫২০ জন রোগী। আর নভেম্বরের গতকাল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৪০৬১ জন রোগী। গড়ে ১ হাজারের ও বেশি। অথচ ডেঙ্গু নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। রয়েছে নাগরিক সচেতনতার ঘাটতিও।
ঢাকা শহরের বহুতল ভবনের বেজমেন্ট, পার্কিং স্থান, গাড়ি ধোয়ার জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের পানি জমা স্থান এবং অনেক এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি, এসব স্থানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সারা বছর প্রজনন করতে পারে। এই পানির উৎসগুলোর সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নেই, তাই শীতকালেও এডিস মশার প্রজনন চলতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের অনেক ভবনের নিচতলা ও বেজমেন্টে দিনের বেলায় প্রচুর এডিস মশা থাকে, যা শীতেও সক্রিয় থাকে। ফলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এডিস মশার ৮০ শতাংশ প্রজনন স্থানই মানুষের আবাসিক বা কর্মস্থল পরিবেশে অবস্থিত। অনেকেই ডেঙ্গু নিধন ‘সরকারের দায়িত্ব’বলে নিজেদের দায়কে এড়িয়ে যেতে চায়, কিন্তু ঝুঁকিতে কিন্তু তারাই পরছে। বাসা বা অফিসের ছাদে, বারান্দায়, ফুলের টবে বা ড্রামে জমে থাকা পানি পরীক্ষা করার অভ্যাস এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকের ধারণা এক-দুই দিনের পানি জমে থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বাস্তবে এডিস মশা মাত্র ৫-৭ দিনে ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একই সঙ্গে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে নাগরিকদের সচেতন হওয়া উচিত। সাধারণ মানুষকে বিসিসির আওতায় এনে তাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নানান কর্মসূচি।
তবে দেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওয়ার্ড পর্যায়ে মশা নিধন কর্মসূচি কেবল ‘দেখানোর জন্য’ চলে। ফগার মেশিনের কার্যকারিতা সীমিত এবং প্রায় সময় এটি ভুল জায়গায় বা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হয়। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার, নয়তো ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।
কেকে/এআর