শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫,
২৩ কার্তিক ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: দেশে বড় অঘটনের শঙ্কা      নানা হিসাব-নিকাশে মনোনয়নবঞ্চিতরা      বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় গৃহীত যত সিদ্ধান্ত      বিএনপি না আসলে এ দেশ ভুটান-কম্বোডিয়ার মতো হতো : প্রকৌশলী তুহিন      মানুষের গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা ও সংকট থেকে মুক্ত করেছেন জিয়াউর রহমান : রিজভী      বৃহস্পতিবারের আলোচিত সংবাদ      ৬৬ দেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে চূড়ান্ত নিবন্ধন দিল ইসি      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বিএনপির রাজনৈতিক পুনর্গঠন
তারেক রহমানের নেতৃত্বের পুনরুত্থান ও প্রত্যাবর্তন
মো. আজমির হোসেন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:৩২ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চিত্র আজও একটি সুসংহত নিদর্শন তৈরি করতে পারছে না। দীর্ঘকাল ধরে চলা রাজনৈতিক দমন, গণআন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নির্বাচনবহির্ভূত শাসন এবং পার্সোনালিটি নির্ভর রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনীতিতে এখন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান সেই পরিবর্তনের সময়টাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। এই নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের কেন্দ্রে অনেক রাজনৈতিক দলের ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে এক নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তারেক রহমান শুধু একজন দলীয় নেতা নয়; তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী চিহ্ন হয়ে উঠতে চাইছেন নীতি-ভিত্তিক, জনভিত্তিক বিকল্প হিসেবে। তবে প্রশ্ন এখনো অপরিসীম; তিনি কতটা সফলভাবে সেই বিকল্পকে বাস্তব রূপ দিতে পারবেন? এছাড়া তার নেতৃত্ব মাঠে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে?

দেশের রাজনীতির এই মুহূর্তে এদেশের সাধারণ মানুষ এক নতুন সম্ভাবনার, এক নতুন নেতার, এক নতুন নেতৃত্বের খোঁজে রয়েছে। তাদের প্রত্যাশা এখন কেবল শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতিনির্ভর নয়, বাস্তব কর্মনির্ভর এবং ধারাবাহিক নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ। রাজনৈতিক জটিলতা, দলীয় দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক চাপের মাঝে এই কঠিন ক্রান্তিকালে তারেক রহমানের সম্ভাব্য স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আগামীর পথচলা কি দেশের জন্য নতুন শক্তি, নতুন আশা এবং নতুন আলো আনবে? এর উত্তর হয়তো সময়ই বলে দেবে, তবে ইতোমধ্যেই জনমতের ধারা পরিবর্তনের অঙ্গীকার দেখানো শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই মঞ্চে তারেকের পদক্ষেপ কি কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হবে, ক্ষমতার পট-পরিবর্তন হবে, নাকি তা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তি স্থাপন করবে?

তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রা সহজ ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে বললে, তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান হিসেবে একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পথ শুধুই পারিবারিক উত্তরাধিকার ছিল না, তিনি ব্যক্তিগত, দলীয় ও সাংগঠনিক নানা বাধা-চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এদেশের রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়েছেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তার স্ত্রী খালেদা জিয়া সেই নেতৃত্বকে ধরে রাখেন। আর তাদের ছেলে তারেক রহমান বিগত দেড় যুগ ধরে নানান রাজনৈতিক প্রতিকূলতা জেল-জুলুম মামলা-হামলা ইত্যাদি মোকাবিলা করে নবদৃষ্টিভঙ্গি ও তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমে দলকে পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বড় সংসদীয় বিজয়ের পর থেকেই তারেক রহমান দলের সাংগঠনিক কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে ২০০৭-২০০৮ সালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা, ২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর নির্বাসন, লন্ডনে থেকেই দল পরিচালনার কৌশল- সব মিলিয়ে তার রাজনীতিক চিত্র আজ এক রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর দমনপীড়ন অনড় ক্ষমতাসীন অবস্থান ও ৫ আগস্ট ২০২৪-এর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন সময় তারেক রহমান রাজনৈতিকভাবে এক নতুন অবস্থানে এসেছেন। তিনি নিজে যেভাবে দল চালিয়ে আসছেন কেন্দ্রীয়, মূল দল, সহযোগী সংগঠন, তৃণমূল, মাঠ-আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে যেভাবে পুনরায় সক্রিয় করার পরিকল্পনা করছেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে যেভাবে যোগাযোগ করছেন সবকিছু মিলিয়ে এটিকে ‘বিএনপির রাজনৈতিক পুনরুত্থান’ বলেই অভিহিত করা যেতে পারে।

এই মুহূর্তে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করে আধুনিক জাতীয়তাবাদের ভাবধারায় জোর দেওয়া এবং বিশেষ করে গ্রাসরুট স্তরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করাটাই এখন তারেক রহমানের রাজনীতির মূল দিক। অন্তর্বর্তী সরকারের জনকল্যাণবিরোধী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে শুধু সরাসরি প্রতিরোধ নয়, অনলাইনে বিভিন্ন সংলাপ, মিডিয়ায় বিবৃতি প্রদান, আন্দোলন-কৌশল ঠিক করা এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করছেন।

প্রবাসে থাকা অবস্থায়ও তিনি প্রায় প্রতিদিনই ভার্চুয়ালি নিজ দলের ও সকল সহযোগী সংগঠনের জেলা, উপজেলা ও বিশেষ ক্ষেত্রে ইউনিয়নের সভায়ও সরাসরি অংশ নিচ্ছেন, ডিজিটাল প্রচারণা চালাচ্ছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গণমানুষের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখছেন। তার সাম্প্রতিক দিক নির্দেশনায় দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড স্তরে তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগ শুধুই ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাই নয়; এটি একটি নীতি-ভিত্তিক, জনভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির প্রক্রিয়া।

তবে তারেক রহমনের জন্য এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই পথ সহজ নয়। রাজনৈতিক মামলাগুলো থেকে মুক্তি পেলেও আইনগত প্রতিবন্ধকতা, দূরবর্তী অবস্থান, দলীয় বিভাজন এবং জাতীয় রাজনীতির গভীর দ্বন্দ্ব- সবকিছুই এখনো তার সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তবু এই বাধা ও চাপের মাঝেও তিনি দেখাচ্ছেন, কীভাবে আধুনিক রাজনীতিতে ব্যক্তি নয়, নীতি ও জনসাধারণের শক্তিই কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নতুন মডেল কি কেবল সম্ভাবনার আলো দেখাবে, নাকি ধীরে ধীরে বাস্তব পরিবর্তনের পথও খুলবে সময়ই তা প্রমাণ করবে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে সাবেক সতের বছরের পতিত ও পলাতক শাসক দল আওয়ামী লীগের অবস্থান এখন আগের মতো দৃঢ় নয়। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন হারানো, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ দলীয় মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীর অভ্যুথান পরবর্তী দেশ ছেড়ে পলায়ন, দলীয় ভাঙন, নেতৃবৃন্দের বিচার প্রক্রিয়া সব মিলিয়ে দলটি এখন প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। শেখ পরিবারের ক্ষমতার দীর্ঘ সময়কাল একক আধিপত্য ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দলটি এখন এককভাবে জাতীয় নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম নয়। ফলে আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের প্রতি নিজ দলের অনেক কর্মী, সমর্থক, রিজার্ভ ভোটার ও আপামর সাধারণ জনগণের আস্থা অনেকটা কমে এসেছে, বিশেষ করে তরুণ, যুব ও মধ্যবিত্ত ভোটারের মধ্যে। 

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগবিহীন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন রাজনীতির মাঠে বিএনপি ক্রমেই পুনরুদ্ধারশীল ভূমিকায় ফিরে আসছে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের কৌশল এখন আরো সুসংগঠিত এবং সমন্বিত। ‘এক আসনে এক প্রার্থী’ নীতি জোরদার করার জন্য সব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় চলমান আছে, মিত্রদল ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন, জোট গঠন নিয়ে দর কষাকষি করা ইত্যাদি নানান উদ্যোগ দলের মাঠ-কৌশলকে দৃশ্যমান শক্তিশালী করেছে।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপির এই নতুন-পুরোনো মিত্রতা জনগণের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা পরিষ্কার নয়। এদিকে, সাম্প্রতিক বিএনপি-জামায়াতের বিতর্কের সঙ্গে এনসিপির সঙ্গেও জামায়াতের বিতর্ক দৃশ্যমান মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে ও যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে।

তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি মাঠের সংগঠন, প্রার্থী মনোনয়ন, মনিটরিং সেল ও উপজেলা পর্যায়ের সংঘাত সমাধান সবকিছুর জন্য বিএনপি নতুন কাঠামো গড়ে তুলেছে। ত্রিমাত্রিক সমন্বয় টিম, বিভাগীয় মনিটরিং সেল, তৃণমূল ঐক্য পরিষদ এসব উদ্যোগ দলের তৃণমূলকে শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত করেছে। ফলে দীর্ঘ ১৭ বছর পর সাবেক আওয়ামী লীগের ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এর একতরফা নির্বাচন পরবর্তী প্রথমবারের মতো বিএনপি সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক ‘ইলেকশন রেডি’ অবস্থায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে, বিএনপির দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর বিশেষ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ও তার জোট, জাতীয় পার্টি ও কতিপয় বাম দলের প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং দৃশ্যমান নেতৃত্বের অভাবে জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। সরকার থাকাকালীন ক্ষমতার অতিরিক্ত অপব্যবহার, দলীয় বিভাজন এবং রাজনৈতিক অন্তর্কলহের কারণে আসন্ন নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ না করার সম্ভাবনা ইত্যাদি নানান সমীকরণে তারা ভোটারের মন জয় করতে পারছে না। এমন অবস্থায় বিএনপি শুধু ধানের শীষ প্রতীক নয়, বাস্তব শক্তিতেই মাঠের রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম দল হয়ে উঠছে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। দেশজুড়ে ছাত্র-নেতৃত্ব আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং পতিত সাবেক আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ সব মিলিয়ে গঠিত হওয় অন্তর্বর্তী (ইন্টারিম) সরকার এই সময়ে আগামী ২০২৬ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন, বিচারব্যবস্থার সংস্কার করছেন এবং নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বিএনপি জোরালোভাবে দাবি করছে, ‘নির্বাচন হবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক।’ অপরপক্ষে, অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় উপদেষ্টা, জামায়াত ও এনসিপি বলছে, নির্বাচন তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার জন্য হ্যাঁ ভোট হবে, সকল পক্ষকে সমানভাবে সুযোগ দেওয়া হবে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি কৌশলগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার জন্য হ্যাঁ/না ভোট আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একসঙ্গে অযোজনের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, নির্বাচনের লক্ষ্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্ধারিত ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে হবে।

তারেক রহমান স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘আমরা জয়ী হব এবং সরকার গঠন করব।’ তবে বিএনপির কৌশল শুধুমাত্র নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে না। তারা একই সঙ্গে মনোযোগ দিচ্ছে মিত্রদল, প্রার্থী মনোনয়ন, মাঠসংগঠন ও জনমতের দিকেও। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিমাত্রিক সমন্বয় টিম এবং বিভাগীয় মনিটরিং সেল চালু করা হয়েছে, যা সব আসনে একক প্রার্থী মনোনয়ন দেবে এবং ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগকে আরও শক্তিশালী করছে। 

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের পরিবেশ কি প্রকৃতপক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে কিংবা বিএনপির প্রতিকূলে থাকবে? বিএনপি অবশ্য বলছে, তারা কেবল নির্বাচন জিতেই থেমে থাকবে না বরং সরকার গঠনের পর দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতেও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির এই পরিকল্পনা প্রমাণ করে যে দলটি কেবল নির্বাচনের জন্য নয়, দেশের জন্যও দৃষ্টি রাখছে। দলের কৌশল ইতিবাচক ও বাস্তবমুখী যেখানে সঠিক প্রার্থী, শক্তিশালী সংগঠন এবং জনমতের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তারেক রহমান মাঝারিপন্থি জাতীয়তাবাদ, বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করছেন। একদিকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্থা ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা নজর রাখছেন, অন্যদিকে রয়েছে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, চীন‑ভারতের প্রতিযোগিতা, পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থ ও রাজনৈতিক অংশীদারত্ব। এসব ক্ষেত্রে, তারেক রহমানের কৌশল হিসেবে বিদেশে অবস্থান থেকেও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি এবং মিডিয়ায় বার্তা প্রচার। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়ায় বার্তা দিচ্ছেন, ‘আমি অতি শিগগিরই দেশে ফিরব, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব।’ তিনি ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার দিকে নজর দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অর্থ ও বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বিনিয়োগ আনা এবং দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করার দিকে বেশি নজর রাখছেন।

নির্বাচনকেন্দ্রিক সময়ে বিএনপি তথ্যভিত্তিক স্বচ্ছ নীতি, দৃষ্টান্তমূলক মনিটরিং সেল ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আমন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের সুশাসনব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে জোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। আমেরিকা, ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রেখে, তরুণ ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের জন্য নতুন রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ সম্ভব। এ ছাড়া, তারা দেশের যুব ও উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রযুক্তি হাব এবং ব্যবসায়িক বান্ধব পরিকল্পনা চালু করতে পারে। দেশের অর্থনীতি, তরুণ প্রজন্ম এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সবদিককে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিএনপি শুধু নির্বাচনের জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুত।

দীর্ঘ সময় বিরোধী দলে থাকার পর কোনো দলের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এত সহজ নয়। বিএনপির ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আরো স্পষ্ট। তারেক রহমান বর্তমানে দলের বিভাজন, প্রার্থী মনোনয়ন সংক্রান্ত সংঘাত, তৃণমূল বিতর্ক ও সার্বিক সংস্কারের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের আভাস মিলছে নতুন বিভাগীয় নেতা এবং তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসছে। ডিজিটাল প্রচার এবং শহুরে, তরুণ ভোটারের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো এখন দলের প্রধান অগ্রাধিকার। তারেক রহমান নিজেও ডিজিটাল ক্যাম্পেইন চালানোর উদ্যোগে কথা বলেছেন। দল বলছে, ‘এক আসনে এক প্রার্থী’ নীতি অনুসরণ করা হবে এবং মিত্রদলগুলোর অবস্থান ঠিক করে মাঠ সংগঠনকে শক্তিশালী করা হবে। তবে সমস্যাও কম নয়। তৃণমূল স্তরে এখনো মনোনয়ন সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব চলমান। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে একাধিক দাবিদার নেতার মধ্যে সংঘাত দেখা দিচ্ছে। কিছু নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে ভোটব্যাংক ধরে রাখার নামে স্থানীয় সংগঠনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচেষ্টা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘যুব প্রজন্ম এসব দেখে হতাশ হয়; তাই নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার আগে এই অপকর্ম মোকাবিলা করা জরুরি।’

দলীয় সংস্কার ও নীতিগত পুনর্বিন্যাস এখনো পুরোদমে হয়নি। মাঠে নতুন জনমত গঠন এবং সংগঠন দক্ষতা বাড়ানো এখনই প্রধান কাজ। এই সংকটের মাঝেই তারেক রহমানের নেতৃত্ব নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তিনি ‘দল থেকে আন্দোলন, সংগ্রাম নয় সংলাপ, ব্যক্তি নয় নীতি’ এই মন্ত্রকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যদি বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে এই রূপরেখায় এগোতে পারে, তাহলে কেবল নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয় বরং রাজনৈতিক সংস্কার ও কৌশলগত শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। এছাড়া, দলের তরুণ নেতৃত্ব এবং ডিজিটাল প্রচার শক্তিশালী হলে শহুরে ও যুব ভোটারের মন জয় করা আরো সহজ হবে। নতুন নীতি ও স্বচ্ছতা উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিএনপি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে খারাপ কথা বলা হতো ‘নির্বাচন হলো শেষ মঞ্চ; এরপর কিছু নেই।’ কিন্তু তারেক রহমানের আধুনিক রাজনৈতিক রণ কৌশল এখন সেই মিথ ভাঙার দিকে রয়েছে। যার বাস্তব উদাহরণ হলো ডাকসু, চাকসু, জাকসু, রাকসু বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয়ের পরেও বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো। মানুষ এখন শুধু ভোট নয়, নীতি, জবাবদিহিতা, শাসনের স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক সুযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এসবের জন্য অপেক্ষায়। নতুন প্রজন্ম বলছে তারা চায় ‘পরিবর্তন’। শত দিনের পুরোনো রাজনীতিতে নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারেক রহমান এই ওঠানামার মধ্যে জনমতের এই পরিবর্তন ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার বলছেনÑ ‘আমরা প্রতিশোধের জন্য রাজনীতি করছি না; পরিবর্তনের জন্য করছি।’ একটি নতুন বার্তা, যা তরুণ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় মনে হত এক নেতা, এক প্রধানমন্ত্রী বা এক বিরোধীর গল্প ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ইতিহাস শুধুই ব্যক্তির নয়; এটি নীতির, সংগঠন‑ক্ষমতার, জনআস্থার ও লিডারশিপ পরিবর্তনেরও। আর এবার তার প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তারেক রহমান। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল নয় পরিবর্তনের সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। 

তিনি বিদেশি মঞ্চে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন বিশেষ করে বিবিসি বাংলা‑এর সাক্ষাৎকারে তিনিই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম,’ ‘আমাদের মানুষের স্বার্থেই কাজ হবে।’ সাক্ষাৎকারটির সমাজমাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে যা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিক্রিয়াকারীর প্রায়  ৮০ শতাংশ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে তারেক রহমান শুধু এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়; তিনি এক সুস্থ‑নীতিমূলক বিকল্প হয়ে উঠে আসছেন। বিএনপি যদি তার নেতৃত্বে সুনীতিধর্মী, সংগঠিত ও জনভিত্তিক রাজনীতি গড়ে তুলতে পারে, তাহলে দেশের রাজনীতির পরবর্তী অধ্যায়ে যদি আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ করে তাহলে বিএনপির নাম শুধু সরকারি দল হিসেবে নয়, পরিবর্তনের বাহক হিসেবে আগামীর বাংলাদেশের ইতিহসে লেখা থাকবে। নতুন বাংলাদেশের ইতিহাসের পরবর্তী খণ্ডে জনাব তারেক রহমান এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হতে পারে যেখানে নতুন নেতৃত্ব, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন স্বপ্নদ্রষ্টা ও এক সুন্দর আগামীর নতুন বাংলাদেশের সূচনার আশা জাগাবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ, ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

দেশে বড় অঘটনের শঙ্কা
নানা হিসাব-নিকাশে মনোনয়নবঞ্চিতরা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় গৃহীত যত সিদ্ধান্ত
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস শুধু বিএনপি নয়, পুরো জাতির কল্যাণ বয়ে আনে : প্রকৌশলী আহসান হাবীব
বিএনপি না আসলে এ দেশ ভুটান-কম্বোডিয়ার মতো হতো : প্রকৌশলী তুহিন

সর্বাধিক পঠিত

জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি
জয়পুরহাট রেলস্টেশনে যাত্রী লাঞ্ছিতের অভিযোগ
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
পরিচ্ছন্ন পরিবেশই একটি গন্তব্যকে পর্যটনবান্ধব করে তোলে : নুজহাত ইয়াসমিন
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে প্রথম সংস্কার শুরু করেছিলেন

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close