রাজধানী ও চট্টগ্রামে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা জনমনে প্রশ্ন ও উদ্বেগ বাড়ছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ঘিরে নতুন করে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন কিছু তথ্য, যা ইঙ্গিত করছে ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত নাশকতা বা চরম প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফল হতে পারে।
প্রতিবেদনে এমন কিছু তথ্য উঠে এসেছে যা ইঙ্গিত করে, একটি প্রভাবশালী পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। একইসঙ্গে তদন্ত কমিটিতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি না রাখায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভাতে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিটকে অনুমতি দেওয়া হয়নি, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে দেরি হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের অনেকেই ছিলেন প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায়, যা প্রশাসনিক সমন্বয়ের বড় ঘাটতির দিকেই ইঙ্গিত করে।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল গোয়েন্দা তৎপরতা ও নিরাপত্তা মনিটরিংয়ে চরম দুর্বলতা। আগুন লাগার শুরুতেই যদি মনিটরিং, প্যাট্রলিং ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা সক্রিয় থাকতেন, তাহলে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এপিবিএন (এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) পরিচালনা করত তিন স্তরের একটি নিরাপত্তা বলয়। এ বলয়ের মধ্যে ছিল ওয়াচ টাওয়ার নিরাপত্তা ডিউটি, ফুট প্যাট্রল এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম যা ২৪ ঘণ্টা চলত।
ওয়াচ টাওয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থার আওতায় এয়ারসাইড থেকে কার্গো গুদামে প্রবেশমুখে ১২ ফুট উচ্চতার তিনটি টাওয়ারের প্রতিটিতে একজন করে সদস্য এবং নিচে (ফিল্ডে) একজন করে মোট ছয়জন এপিবিএন সদস্য নিয়োজিত থাকতেন। তারা উচ্চ স্থান থেকে পুরো আমদানি কার্গো এলাকা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতেন।
এ ছাড়া ৮নং হ্যাঙ্গার গেট থেকে ১১নং বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত এলাকায় দুটি ফুট প্যাট্রল টিম মোতায়েন ছিল প্রতিটি টিমে দুজন করে সদস্য দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের কাজ ছিল কার্গো এলাকায় পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সন্দেহজনক কোনো গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা। এপিবিএনের গোয়েন্দা ইউনিটেও ছিল পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ দল, যারা আমদানি ও রপ্তানি কার্গো এলাকায় কর্মরত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের গতিবিধি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করত।
এই তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থার সমন্বয় করত এয়ারসাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে দায়িত্বরত এপিবিএন ইনচার্জ, যিনি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে গোয়েন্দা নজরদারি, নিরাপত্তা এবং মালামালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেন। তবে ৫ আগস্টের পর বেবিচক (সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ) নির্দেশে বিমানবন্দরের এয়ারসাইডে এপিবিএনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কার্গো এলাকায় সব ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি, প্যাট্রলিং ও নিরাপত্তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তোলে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৮ অক্টোবর (শনিবার) দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো গোডাউনের এক কোণে প্রথমে ধোঁয়া দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি মনিটরিং ও প্যাট্রলিং কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হতো এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল প্রাথমিক পর্যায়েই।
সংকটের মুহূর্তে বিমানবন্দর এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এপ্রোন এলাকায় প্রবেশ করে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার অনুমতি চায়, তবে তারা অনীহা প্রকাশ করেন। পরে এপ্রোন এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় এপিবিএন সদস্যরা আমদানি কার্গো ভিলেজের বাইরের দিক থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এপিবিএন ও আনসার সদস্যরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও, কর্তব্যরত কিছু সদস্যকে প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় দেখা যায়।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে এখন পর্যন্ত তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কমিটিটি আগুনের উৎস নির্ণয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতি ইউটিউব চ্যানেল লাইভবিডি২৪-এ এক সরাসরি আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড নাশকতা, অবহেলা নাকি দুর্ঘটনা। এটা নাশকতা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হতে হবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে যত ধরনের অর্থনৈতিক স্থাপনা আছে, যেগুলো দিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে যে লাইটার জাহাজ ডুবেছে তাও তীরের কাছে এসে ডুবেছে, এটা সন্দেহজনক। বিমানবন্দর হচ্ছে কেপিআই এলাকা, যেখানে আইডি পাঞ্চ করা ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। দেড়ঘণ্টা সেখানে আগুন ওপেন ছিল, ওই সময় তা নিভানো হয়নি, তাদের ব্লক করা হয়নি, বাইরে থেকে যখন ফায়ার ফাইটার আসছে কেপিআইয়ের দোহাই দিয়ে ঢুকতে দেয়নি। ফলে এটা যে নাশকতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমানকে দোষারোপ করলেও কাউকে সরাসরি দায় দিতে চাননি বেবিচক চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, তদন্ত যেহেতু চলছে, এটা শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা ঠিক নয়। আমি কারো দিকে আঙুল তুলতে চাই না।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি কমপ্লেক্সে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার কোনো দায় নেননি মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক। তার ভাষ্য কার্গো ভিলেজটি বেবিচকের হলেও এটির কার্যক্রম পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) এজেন্ট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তাই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমানকে দোষারোপ করলেও কাউকে সরাসরি দায় দিতে চাননি বেবিচক চেয়ারম্যান। বলছেন, তদন্তের আগে এমন কিছু বলা ঠিক নয়।
এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, কার্গো কমপ্লেক্সের আগুন লাগার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে ছুটে গিয়েছিল বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটের অত্যাধুনিক রোজেনবাওয়ার প্যান্থার সিরিজের গাড়িগুলো। কিন্তু গুদামের সামনের খোলা জায়গায় অনেকটা জুড়ে বহু মালপত্র পড়ে থাকায় ফায়ার ইউনিটের গাড়িগুলো ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যেতে পারেনি। আর কার্গো কমপ্লেক্সের যেই কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেখানকার অবকাঠামোগুলো ছিল খুব খোপ খোপ এবং অনেক শক্ত।
তিনি বলেন, কুরিয়ারের খোপ ভেঙে প্রাথমিকভাবে আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয় বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো কমপ্লেক্সে।
কেকে/ এমএস