রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫,
২৭ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      মঙ্গলবার থেকে কর্মবিরতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা      নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা      অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল      
খোলাকাগজ স্পেশাল
আমলাতে বিতর্কিত সরকার
আলতাফ হোসেন
প্রকাশ: সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৯:৩০ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে ক্রমশ বিতর্ক বাড়ছে। নেতৃত্বের সংকট, নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত প্রভাব সব মিলিয়ে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বিস্তারে সরকার এখন এক অস্বস্তিকর অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

তারা বলছেন, প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা একাধিক আমলা সরাসরি নীতিনির্ধারণে জড়িত, ফলে আমলাতন্ত্রই হয়ে উঠেছে সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু এ নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। কারণ, যেসব আমলা অতীতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন, তারাই আবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে সরকার পরিচালনায় ভূমিকা রাখছেন। 

অন্যদিকে পদায়ন ও পদোন্নতিতে বৈষম্য, যোগ্য কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়ন এবং আর্থিক লেনদেন ও পছন্দের লোকদের পদায়নের অভিযোগ উঠেছে। সামগ্রিকভাবে প্রশাসনে নীতিগত অস্বচ্ছতা ও বিতর্কিত নিয়োগের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম সমালোচনার মুখে পড়েছে।

জনপ্রশাসন সচিব পদটি সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। রোববার হঠাৎ করেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে। ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট মোখলেস উর রহমানকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন বিসিএস প্রশাসন ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ওঠে। তার সময়কালে পদায়ন ও পদোন্নতিতে বৈষম্য এবং ‘যোগ্য কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়ন’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। 

সচিব, সংস্থা প্রধান, জেলা প্রশাসক নিয়োগে ‘নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলার’ অভিযোগ ওঠে, আর্থিক লেনদেন এবং পছন্দের লোকদের পদায়নসংক্রান্ত খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের একের পর এক পদায়ন ক্ষোভের জন্ম দেয় প্রশাসনের ভেতরেই, এসব কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে ধারণা করছেন অনেকেই। যদিও সরকারি প্রজ্ঞাপনে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মো. জসীম উদ্দিনকে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি বিতর্কের মুখে পড়েন। অভিযোগ ওঠে যে, অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তাকে এ পদে বসানো হয়েছিল। মাত্র ৮ মাসের মাথায় তাকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা কবির বিন আনোয়ার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিতর্কিত হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, কক্সবাজারের পেঁচার দ্বীপে সাগর ভাঙন রোধে জরুরি প্রকল্পের বরাদ্দ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত রিসোর্ট রক্ষা করার চেষ্টা করেন।

সম্প্রতি বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি ঘুষ দিয়ে বাণিজ্য সচিবের পদ পেয়েছেন। এরপরে তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেতে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেন। মাহবুবুর রহমান জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য পাচার মামলার অন্যতম আসামি। এ মামলায় তিনি সজীব ওয়াজেদ জয় এবং পলকের সঙ্গে ৬ নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত। 

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে পরিবর্তন শুরু হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি, পদায়ন ও নতুন নিয়োগের পাশাপাশি একাধিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল করা হয়। দেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি দপ্তরের শীর্ষ আমলা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অনেকেই পদ ছেড়ে যান। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে বিতর্কিত নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমলাদের একে একে সরিয়ে দেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকরা নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন। যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম, তাদের ওএসডি করা হয়, আর যাদের বয়স ২৫ বছরের বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের এবং তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দূতাবাস ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। 

এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুর দিকেই ৩৩ যুগ্ম সচিবকে ওএসডি করা হয়, যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। এসব পদ পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার যারে নিয়োগ দেন, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী। 

সরকারের নানা সিদ্ধান্তে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকদের দাবি। তারা মনে করছেন, জনগণ থেকে সরকারের দূরত্বও বাড়ছে। অন্যদিকে সরকারি মহল বলছে, কঠিন সময় মোকাবিলায় অভিজ্ঞ আমলাদের দক্ষতা কাজে লাগানো হচ্ছে মাত্র।
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা ও ন্যায্যতা কমিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার উচ্চ পদে বিতর্কিত ও রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের নিয়োগ শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা কমাচ্ছে না, বরং সরকারি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের স্বচ্ছতাও প্রভাবিত করছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি আমলাদের মধ্যে দুর্নীতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না, বরং জনগণের আস্থাও কমিয়ে দিচ্ছে। দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক (এলপিআর) ড. মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের মতো করে প্রশাসনে নিয়োগ দেয়। এগুলো মূলত সরকারের উচ্চ স্তরের নীতি ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি কোনো কর্মকর্তা সরকারের নীতির সঙ্গে খাপ না খায়, তাহলে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এটি একটি রুটিন প্রক্রিয়া। সরকারের নীতির সঙ্গে যারা কাজ করে, তাদের মূল্যায়ন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘ক্যারিয়ার সিভিল কর্মকর্তারা যে সরকারই থাকুক, সেই সরকারের নির্দেশ ও নীতির সঙ্গে মিল রেখে কাজ করেন। সরকারের উচিত এ বিষয়ে আরও সতর্ক থাকা। কর্মকর্তাদের অতীত রেকর্ড বিবেচনা করে নিয়োগ ও পদায়ন করলে ফল আরো ফলপ্রসূ হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সময়ে প্রশাসনে যারা সুবিধাভোগী ছিল, বর্তমান সরকার তাদের অনেককেই আবারও পদায়ন করেছে। মূলত তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারায়, এখনো প্রশাসনে কর্তৃত্ববাদী ধারা বহাল রয়েছে। 

তিনি বলেন, ‘এক বা দুই স্তরে পরিবর্তন করে কোনো ফল হবে না। অন্তত ১০ স্তর পর্যন্ত গেলে দেখা যাবে, একই ধরনের লোকজন পুরো প্রশাসনজুড়েই রয়ে গেছে। তবে সবাইকে ফেলে দিতে হবে, এমন নয়।’

ড. মাহবুবুর রহমানের মতে, সরকারের উচিত ছিল অন্তত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, যারা সার্ভিস রুল ভঙ্গ করে আগের সরকারকে সুবিধা দিয়েছে বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সরকার তা করেনি। বরং এসব ব্যক্তি এখনো প্রশাসনে বহাল রয়েছেন এবং আগের সরকারের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে নানা অনিয়ম করেও তারা শাস্তি এড়িয়ে গেছেন।

তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিত ছিল একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা, যারা সার্ভিস রুল লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করে সরকারের কাছে সুপারিশ দিত। কিন্তু এ উদ্যোগ না নেওয়ায় এখনো প্রশাসনে প্রধানত দুধরনের লোক বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী শাসনকালে সুবিধাভোগীরা অথবা দুর্নীতিবাজরা। কেবল অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম মানুষই প্রশাসনে কাজ করছেন।

ড. মাহবুবুর রহমান মনে করেন, এ সীমিত সংখ্যক ব্যতিক্রম দিয়ে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সমাজে কাক্সিক্ষত শৃঙ্খলা ও সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, প্রশাসনের বড় অংশই সরকারের সফলতায় আন্তরিক নয়। তিনি বলেন, ‘যারা গত সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছে, তারা এখন সেই সুবিধা পাচ্ছে না। তাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য সফল হতে দিচ্ছে না।’

কেকে/ এমএস
আরও সংবাদ   বিষয়:  আমলা   বিতর্কিত   সরকার  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

কুমিল্লায় শিয়ালের কামড়ে শিশুসহ আহত ৭
নবীনগরের কালিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট চরমে
২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের
সিলেটবাসী নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত : আরিফুল
নির্বাচনসহ ৫ দফা দাবিতে জামায়াতের মিছিল ও স্মারকলিপি

সর্বাধিক পঠিত

সাপ্টিবাড়ী ডিগ্রি কলেজে চরম দুর্নীতি ও অনিয়ম
রাজশাহীতে চার পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ
রায়েরবাজারে দুই মাস ধরে অর্ধসমাপ্ত সাদেক খান সড়ক
মৌলভীবাজারে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন
গাজীপুরে টাইফ‌য়েড টিকা প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close