কী চমৎকার দেখা গেল, ডানে বামে নজর করো, ইন্দিরা গান্ধী এসে গেল। ৩ কাঠা ভুঁই জুড়ে গেল। আহা দাদা এসে গেল, পাকিস্তানি এসে গেল রুটি বলা বলে গেল। এই বারেতে আইসা গেল, সোনারগাঁও দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল ঈসা খান এসে গেল- এ সুর আর ছন্দের তালে ও ধারা বিবরণী মত্ত থাকতো বয়োস্কোপের দর্শকেরা।
খঞ্জনি আর গানের তালে বাক্সের ভেতর পাল্টে যেত ছবি। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যেত ছেলে-বুড়ো সবাই। বায়োস্কোপের সেই দিনগুলি এবং ছেলেবেলার মনোমুগ্ধকর সেই দৃশ্য যেন আজ শুধুই স্মৃতি। গ্রাম-গঞ্জের মেলাতেও এখন দেখা মেলে না হারিয়ে যাওয়া সেই দৃশ্য। বায়োস্কোপ বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের নাম। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে দেখা এক ভ্রাম্যমাণ সিনেপ্লেক্স।
বর্তমানে গ্রাম-বাংলায় বায়োস্কোপ এমনই বিরল যে, জাদুঘরে রেখে দেওয়ার জন্যও অন্তত একটি বায়োস্কোপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বায়োস্কোপের সঙ্গে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনপদে বেড়ে ওঠা মানুষকে তো বটেই। তবে যারা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবনযাপন করে অভ্যস্ত কিংবা যাদের জন্ম এক যুগ আগে তাদের কাছে হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্স মনে হবে। কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও হাস্যকর কোনো বস্তু ছিল না, কিংবা ছিল না কোনো বোকা বাক্সও!
প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ গ্রাম বাংলার এক বাক্সবন্দি সিনেমা হল। রং-বেরঙের কাপড় পড়ে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত ধারা বর্ণনা করতে করতে ছুটে চলত গ্রামের স্কুল কিংবা সরু রাস্তা ধরে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পেছন পেছন বিভোর স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াত গ্রামের ছেলে-মেয়েরা।
বায়োস্কোপওয়ালার এমন ছন্দময় ধারা বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে ঘর ছেড়ে গ্রামের নারী-পুরুষ ছুটে আসত বায়োস্কোপের কাছে। একসঙ্গে সবাই ভিড় জমালেও ৩ কি ৪ জনের বেশি একসঙ্গে দেখতে না পারায় অপেক্ষা করতে হতো ঢের সময়। সিনেমা হলের মতো এক শোর পর আবার আর ৩ বা ৪জন নিয়ে শুরু হতো বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলেই ‘কি চমৎকার দেখা গেল’ বলে ফের শুরু হতো বায়োস্কোপওয়ালার ধারা বিবরণী। আর এ বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে দু’মুঠো চাল কিংবা ৪ আনা নিয়েই মহাখুশি হয়ে ফিরে যেত বায়োস্কোপওয়ালা।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার বিনোদনের এ লোকজ মাধ্যমটি। টিভি আর আকাশ সংস্কৃতি স্যাটেলাইট ও স্মার্ট মোবাইলের সহজলভ্যতার কারণে আপনা-আপনিই উঠে গেছে বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ প্রদর্শনের বিষয়বস্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বিভিন্ন প্রেম কাহিনী, তারপর যুদ্ধ, বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় বিষয় ও রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বায়োস্কোপ দেখানো হতো। এ জন্য তাদের বহু বেশি জানতে হতো। তারপর সেটা প্রদর্শনের সময় এক এক করে ছন্দ মিলিয়ে বলতে হতো। তাহলেই দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে আগ্রহী হতো। একসঙ্গে ৬ জন দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে পারত।
টেলিভিশন ও হাতে মোবাইল ফোন চলে আসায় এখন আর আগের মতো বায়স্কোপের প্রতি দর্শকদের চাহিদা নেই বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। এক যুগ আগেও বায়োস্কোপের যে জৌলুস ছিল, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় তা আজ বিলীন হয়ে গেছে।
তবুও আধুনিক মাল্টিমিডিয়ার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বায়োস্কোপেও ছবি পাল্টায়, নতুনত্ব আনে। চেষ্টা করে দর্শকের মনোরঞ্জনের। কী চমৎকার দেখা গেল এই বারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’ এভাবেই সুর আর ছন্দের তালে তালে বায়োস্কোপের কাচের জানালায় চোখ রাখলে ছবি আর বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠত অজানা পৃথিবী। আর গ্রামের সেই ছোট শিশু বা কিশোরের কাছে সেটা এক নতুন পৃথিবী।
শালিখা উপজেলা আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের ধলা কাজী বলেন, ‘আমরা নিজে দেখেছি ওই বায়োস্কোপ। দুপুরে বাড়ির উঠোনে বাক্সটা নিয়ে বসত। বাড়ির সবাই একে একে দেখতাম। আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আমরা এখন আকাশ সংস্কৃতির ঘেরাটোপে বন্দি।’
শ্রী ইন্দ্রনীল গবেষণা ইনিস্টিউটের প্রধান সংগঠক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, ‘বায়োস্কোপ বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার জন্যই মাসব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এবারের মেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় ঘটানোর জন্য বায়োস্কোপ আনা হয়েছে। বিগত কয়েক বছর মেলায় তাকে আনা হয়েছিল। বায়োস্কোপ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য বহন করে।’
কেকে/ এমএ