কফি একটি জনপ্রিয় পানীয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কনফারেন্স চলাকালে টি ব্রেক বা কফি ব্রেক বলে খ্যাত ছোট্ট বিরতির এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানে এক সময় ব্রিটিশরা কফি চাষ করলেও তারা চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে কফি চাষ কমে যায়।
চায়ের জন্য পরিচিত এই অঞ্চলটি এখন কফির সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে। কফি চাষের জন্য জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন উপজেলায় বিনামূল্যে চারা বিতরণ করছে। এর ফলে স্থানীয় কৃষকরা চায়ের পাশাপাশি কফি চাষেও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার নতুন পথ খুঁজে পাচ্ছেন।
জানা যায়, এ বছর মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি বাণিজ্যিকভাবে ভালো ফলন দিচ্ছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আকবরপুর, শ্রীমঙ্গল, রাজনগরসহ অন্যান্য এলাকার চাষিরা কফির বাগান স্থাপন ও সফলভাবে ফলন সংগ্রহ করছেন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়ান নগর ইউনিয়নের আকবরপুরের কৃষক আব্দুল মান্নান তার বাগানে ১,৮০০ কফি গাছ লাগিয়ে ইতিমধ্যে লক্ষাধিক টাকার কফি বিক্রি করেছেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডলুছড়া গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা মো. আতর আলী জানান, তার কফি বাগানে প্রায় ৩০০ কফি গাছ রয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি ৩ বার ফলন পেয়েছেন এবং ২৫ হাজার টাকার কফি বিক্রি করেছেন।
রাজনগরের উত্তরবাগ চা বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার মো. লোকমান চৌধুরী জানান, তাদের বাগানে ৩,০০০ কফির চারা রোপণ করে নতুন বাণিজ্যিক কফি বাগান তৈরি করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও আকবরপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও চারা বিতরণের মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি ও টিলা সমৃদ্ধ এলাকা কফি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কফি চাষে সফলতা পাওয়ায় অনেকেই এখন কফি চাষের দিকে আগ্রহী হচ্ছেন এবং এই অঞ্চলের কৃষকরা নতুন একটি আয়ের উৎস খুঁজে পাচ্ছেন। ফলে দিন দিন জেলায় কফি চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। এখানকার আবহাওয়া ও জলবায়ু কফির জন্য অনুকুল হওয়ায় বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক।
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগান এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, উপজেলার জাগছড়া ও সোনাছড়া চা বাগানে ফিনলে কোম্পানির বিশাল কফি বাগান আর কফির ফ্যাক্টরি ছিল। চা উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় কফি চাষ কমে যায়। ১৯৮৫ বা ৮৬ সালের দিকে ফিনলে কফি চাষ বন্ধ করে সেখানে চা আবাদ বর্ধিত করে। পুষ্টিবিদরা বলেন, কফির মাঝে রয়েছে বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান।
মৌলভীবাজারের আবহাওয়া ও মাটি কফি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। স্থানীয় কৃষকরা কফি চাষে আগ্রহী হওয়ায় জেলা সরকারও বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ বিস্তারের পরিকল্পনা নিয়েছে। পরিকল্পিত চাষ, প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মৌলভীবাজার দেশের শীর্ষ কফি উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।
পুষ্টিবিদদের মতে, কফিতে বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। একটি ১২৫ মিলিলিটার কাপ কফিতে খুব কম ক্যালোরি থাকে, তবে খনিজ ও ভিটামিন উপাদান সমৃদ্ধ। ফলে কফি চাষ শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, বরং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
চা-বাগানের পাশাপাশি কফি চাষ মৌলভীবাজারে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করছে। কৃষকরা এতে আয়ের উৎস বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং কৃষকদের উদ্যোগ মিলে কফি চাষ অঞ্চলে একটি নতুন কৃষিপণ্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি জানান, জেলায় কফি চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকদের মাঝে আমরা কফির চারা বিতরণ করেছি। ইতোমধ্যে এ জেলায় কফি চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রস্তাব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। পতিত জমি এবং মিশ্র ফলের বাগানে কফি চাষ করে অনেকেই সফল হচ্ছেন।
কেকে/ এমএস