অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়াকে নিয়ে যেন বিতর্কের শেষ নেই। সরকারের এক বছরে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে তার নাম। সবশেষ এবার তার নাম জড়িয়েছে চাঁদাবাজিতেও।
রাজধানীর গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আকতারের বাসায় আলোচিত চাঁদাবাজির ঘটনায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
গত বুধবার রাতে মামলার অন্যতম আসামি জানে আলম অপুর একটি স্বীকারোক্তির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে তিনি এই চাঁদাবাজির ঘটনায় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন। তবে অপুর স্ত্রী আনিসা সংবাদ সম্মেলন করে সেখানে দাবি করেন, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন নির্যাতনের মাধ্যমে অপুকে সেই ভিডিও ধারণ করতে বাধ্য করেন।
আনিসা দাবি করেন, ঘটনার দিন অপু ঢাকায় ছিলেন না, কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে অবস্থান করছিলেন। তার ভাষায়, ‘অপু আগেই আঁচ করেছিল যে, তাকে এ ঘটনার মধ্যে ফাঁসানো হবে।’ এ সময় ভাইরাল হওয়া সিসিটিভির ফুটেজ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অপুর স্ত্রী। তার ভাষ্য, ভিডিওতে যাকে দেখা গেছে, সে আসলে অপু নয়।
বিএনপি নেতা ইশরাকের সঙ্গে অপুর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপুর কী সম্পর্ক সেটা আমি জানি না। তবে তাকে ব্যবহার করে একটি দল নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আনিসা আরো অভিযোগ করে বলেন, ‘৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার পর থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত অপুকে আটক করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। গোপীবাগে যে বাসায় এই ঘটনা ঘটে, সেটা তো ইশরাক ভাইয়ের বাসা।’ তার দাবি, অপুকে ইশরাক হোসেনের বাসার সামনেই আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ওই বাসা থেকেই ছড়ানো হয়েছে।
এদিকে চাঁদাবাজির অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যা বলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একজনের যে স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে, তা জোর করে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। আসিফ মাহমুদ বলেন, তার (অপু) স্টেটমেন্টে আমার নাম আসার পর একরকম অবাক হয়েছি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। তার স্ত্রী পরিচয়ে একজন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তাকে জোর করে গুম করে স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকেও এমন শুনছি, গুম করে স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়। ৫ আগস্টের পর এমন ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘মাঝে-মধ্যেই রাতে যখন কাজ শেষ হয়, কখনো কখনো ভোরও হয়ে যায়, ওই সময় রাতের খাওয়া-দাওয়া দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। আমি বেশির ভাগই যাই ৩০০ ফিটের নীলা মার্কেট বলে একটা জায়গায়। ওখানে হাঁসের মাংস খুব ভালো পাওয়া যায়। ওখানে হয়তো যাই চার-পাঁচজন মিলে। ওটা আবার বেশি ভোর হয়ে গেলে বন্ধ থাকে। তখন ওদিকে ওয়েস্টিনে যাওয়া হয়। তবে ওই দিন আমি গিয়েছিলাম কিনা, সেখানে ছিলাম কিনা এটা আমার মনে নাই।’
তিনি আরো বলেন, সিসিটিভিতে যে কাউকে যদি আমি বলে দাবি করা হয় এটা আসলে কতটা বিশ্বাসযোগ্য আমি জানি না। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। এটা তদন্তাধীনের একটা বিষয়। তারপরও অনেক কিছু বললাম, কারণ আমার নাম এসেছে। তবে হেলমেট পরা যে কাউকে যে কারো সঙ্গে মিলিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, গুলশানের চাঁদাবাজির ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা জড়িত কিনা, তা স্পষ্ট এবং সবটা জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি একথা বলেন।
এর আগে গুলশানে সাবেক মহিলা এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের ঘটনার একটি ফুটেজ আলোড়ন তোলে গোটা দেশে। সেই ঘটনায় মামলা হলে ২ আগস্ট গ্রেফতার হন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু। এর কিছু আগে একই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় মোট ৬ জনকে। গ্রেফতারের পর আসামিদের চারদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
অভিযোগ ছিল সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পাঁচ নেতা। শাম্মী পলাতক থাকায় তার স্বামীর কাছে এ চাঁদা দাবি করা হয়। কয়েক দিন আগে তারা ওই বাসায় গিয়ে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আসেন। সবশেষ গত ২৬ জুলাই রাতে আবারো ওই বাসায় গিয়ে ৪০ লাখ টাকা আনতে যান এই পাঁচ যুবক। পরে পুলিশে খবর দিলে তাদের আটক করে গুলশান থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। এতে তিনি ছয়জনকে আসামি করেন। আসামিদের মধ্যে গ্রেফতার চারজন ছাড়া বাকি দুজনের একজন শিশু। অন্যজন জানে আলম অপু।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ১৭ জুলাই সকাল ১০টায় আসামি বৈষম্যবিরোধী নেতা রিয়াদ ও অপু গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে সাবেক এমপি শাম্মী আহম্মেদের বাসায় যান। তখন তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দাবি করেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ আখ্যায়িত করে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানোর হুমকি দেন এবং টাকা চেয়ে চাপ দিতে থাকেন তারা। এক পর্যায়ে সিদ্দিক আবু জাফর বাধ্য হয়ে নিজের কাছে থাকা নগদ ৫ লাখ টাকা ও ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আরো ৫ লাখ টাকা দেন। এরপর ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে রিয়াদ ও অপু বাদীর বাসায় প্রবেশ করে তার ফ্ল্যাটের দরজায় সজোরে ধাক্কা মারেন। বিষয়টি গুলশান থানা পুলিশকে মুঠোফোনে অবহিত করলে আসামিরা চলে যায়।
২৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় আবার রিয়াদের নেতৃত্বে অন্য আসামিরা বাদীর বাসার সামনে এসে তাকে খুঁজতে থাকেন। বাসার দারোয়ান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাকে বিষয়টি জানান। তখন আসামিদের দাবি করা বাকি ৪০ লাখ টাকা না দিলে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। পরবর্তীতে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করলে তাৎক্ষণিক গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাঁচজনকে হাতেনাতে আটক করে। এ সময় অন্য আসামি অপু পালিয়ে যান।
কেকে/ এমএস