আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না এ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের পিছু ছাড়ছে না ‘সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা’। এখন আবার ওই শব্দগুলোই নতুন করে আলোচনায় আসছে। ফলে এখনো মেঘ কাটেনি বাংলাদেশের নির্বাচনি আকাশের, ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ।
যদিও ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন শনিবার রংপুরে বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্ত এরপরও এখন ভোটের ব্যাপারে নতুন করে সন্দেহ, সংশয়ের কথা আসছে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, রাজনীতিকদেরই অনেকে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
সরকারের একাধিক উপদেষ্টা অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো চিন্তা সরকারের ভেতরে নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। সরকারের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। একইসঙ্গে দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
এদিকে গতকাল রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের জানিয়েছেন, সংসদের উভয় কক্ষে (উচ্চ ও নিম্ন) আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানাবে তারা। দাবি বাস্তবায়ন না হলে প্রয়োজনে আন্দোলনে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তাহের বলেন, ‘জামায়াত নির্বাচনের পক্ষে। ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন ঘোষিত হয়েছে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবি জানাব এবং প্রয়োজনে আন্দোলন করব।’
তিনি বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির অভিজ্ঞতা ‘সুখকর নয়’ উল্লেখ করে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পিআর পদ্ধতি দরকার। পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বজুড়ে এটি প্রচলিত এবং জনগণের ভোটাধিকারের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব। তিনি আরো বলেন, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জনগণের দাবি, যেটি বাস্তবায়নে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অতীতের তিন নির্বাচনে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে ‘সতর্কতার সঙ্গে’ স্বাগত জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। দলটি বলেছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নিয়ে তারা এখনো পুরোপুরি আস্থাশীল নয়। এক বছর হতে চলেছে, কিন্তু রাজনৈতিক দল বা অংশীজনদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সংলাপের কোনো আয়োজন বা উদ্যোগ তারা এখনো দেখতে পাচ্ছে না। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ তারা বাস্তবায়নে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে, যেটা দুঃখজনক।
শনিবার রাজধানীর বিজয়নগরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তিনি বলেন, রমজানের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের ঘোষণাকে তারা স্বাগত জানাচ্ছেন। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাসিবাদীদের বিচার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা কাটবে না। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার এখনো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরো লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের স্পষ্ট পথনকশা জরুরি, যেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী সরকারও এগুলো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
জুলাই সনদের যেসব বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে, সেগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই বাস্তবায়ন শুরু হওয়া দরকার উল্লেখ করে এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুরাহা হওয়া জরুরি। আমরা যেন ইতিহাসের পেছনের দিকে চলে না যাই; ১৯৯০ ও ২০০৮ সালের অভিজ্ঞতা ভুলে না যাই। যেটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখনই করা সম্ভব, সেটা পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার পরিপন্থি।’
একইসঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে এবি পার্টি। তবে এ ঘোষণাপত্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও জনগণের স্বপ্ন ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে দলটি। আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, একটা ঘোষণাপত্র দিতে পেরে আনন্দিত ও গর্বিত। কিন্তু এর বক্তব্য, গাঠনিক শৈলী, অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি পুরোনো ধাঁচের হয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের মুক্তিসংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, শাহবাগে ফ্যাসিবাদের উত্থান পর্ব, ৫ মে’র জাগরণ ও আলেমদের ওপর গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, কোটা সংস্কার থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, রাষ্ট্র মেরামতের জন-আকাক্সক্ষা হয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের দৃঢ়প্রত্যয়ের স্মৃতিমণ্ডিত ইতিহাস ঘোষণাপত্রে আরও স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে বলে প্রত্যাশা ছিল।
এদিকে রাজনীতির বাইরে সাধারণ মানুষের মাঝে নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে সংকট কেটে গেছে এবং আগামী বছর রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে এমন বক্তব্য তুলে ধরে বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্বাচনমুখী তৎপরতাও শুরু করেন।
ফলে কোনো দলই বসে নেই। নির্বাচন লক্ষ্য রেখে দলগুলো নানা কর্মসূচি পালন করছে। রাজনীতিতে অনেক রকম মেরুকরণও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এরপরও প্রশ্ন উঠছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে কি না? এমনকি নির্বাচন হবে কি না, এ ধরনের আলোচনাও রয়েছে রাজনীতিতে। এমনকি সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বললে তাদেরও অনেকে এসব প্রশ্ন করেন।
তবে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ বা সংশয়ের কারণ কী এ প্রশ্নে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে অনেকটা একই ধরনের জবাব পাওয়া গেছে। বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা-এসব জেলায় বিএনপির শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান রয়েছে। এই জেলাগুলোর বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা নির্বাচন প্রশ্নে সংশয় বা সন্দেহের পেছনে সরকারের ভূমিকাকে দায়ী করেন। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতাও অনানুষ্ঠানিক আলাপে তৃণমূলের সঙ্গেই সুর মিলিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিটাকে ধোঁয়াশা, অস্পষ্টতা বলে বর্ণনা করছেন বিএনপি নেতাদের অনেকে। তারা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন নিয়ে তাদের সংশয়, সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
লন্ডন বৈঠকের পর বিএনপি নেতাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বিবৃতিতে সরকারের সমালোচনা কমেছে। কারণ যেহেতু তারা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে বলে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে ধৈর্য ধরে রেখে কৌশলে নির্বাচন আদায় করতে চাইছে দলটি।
বিএনপি নেতাদেরই কেউ কেউ মনে করেন, লন্ডন বৈঠকের কারণেও সরকারের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রেখে এগোনোর একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এরপরও নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের ক্ষেত্রে বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, সব পর্যায়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিএনপির মিত্র দলগুলোও পরিস্থিতিটাকে একইভাবে দেখছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের মধ্যে দোলাচল বা দোটানা আছে। সেকারণে ধোঁয়াশা রাখা হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। একজন বিশ্লেষক বলছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন পক্ষকে এক জায়গায় আনতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনকে এখনো শক্তভাবে দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা যাবে কি না, এ প্রশ্ন থাকে। আর সেজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা বাড়ছে।
কেকে/ এমএস