সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর পদ্ধতি) নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে লাখো জনতার সমাগমের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশ। শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথমবারের মতো এ সমাবেশ করেছে দলটি। এদিন দুপুর ২টা থেকে সমাবেশের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে মঞ্চের চারপাশে নেতাকর্মীতে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। যদিও এর আগেই মঞ্চ নির্মাণ, অতিথিদের জন্য আসন, বিভিন্ন স্থানে মাইক, বড় পর্দা স্থাপন, উদ্যানজুড়ে জামায়াতের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ বসানোর কাজ ভোরের আগেই শেষ হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দুই দিকে প্রবেশপথে তৈরি করা হয় বিশাল গেট।
সকাল ১০টায় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু হয়। এরপর হামদ-নাত ও ইসলামি সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর বেলা দুইটায় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও নাতে রাসুলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশের মূল পর্ব। নাতে রাসুল পরিবেশন করেন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। পরে সমাবেশে উপস্থিত জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বক্তব্য দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান। এরপর ধারাবাহিক বক্তব্য দেন দলটির কেন্দ্রীয় ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা।
সমাবেশের শেষ প্রান্তে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বক্তব্য দেওয়ার সময় হঠাৎ করে পড়ে যান। নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় উঠে দাঁড়ালেও দু-একটি কথা বলার পর আবারো পড়ে যান তিনি। পরে বসে থেকেই নিজের বক্তব্য শেষ করেন। এ সময় জামায়াত আমির বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ যত সময় হায়াত দিয়েছেন, তত সময় মানুষের জন্য লড়াই করব, ইনশাআল্লাহ। এ লড়াই বন্ধ হবে না। বাংলার মানুষের মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। বলছিলাম, জামায়াত যদি আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের ভালোবাসায় দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়, তাহলে মালিক হবে না, সেবক হবে, ইনশাআল্লাহ। আজ আমি ঘোষণা দিচ্ছি, লক্ষ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত থেকে যারা আগামী দিনে সংসদ-সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন...।’
তিনি বলেন, ‘যদি আল্লাহর ইচ্ছায় ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত থেকে সংসদ-সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে কোনো এমপি-মন্ত্রী আগামী দিনে সরকারি কোনো প্লট গ্রহণ করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়ি চড়বেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী যদি তার নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন।’
চাঁদাবাজি প্রতিরোধের প্রত্যয় ব্যক্ত করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করব না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি সহ্য করব না। এ বাংলাদেশটাই আমরা দেখতে চাই। যুবকদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তোমাদের সঙ্গে আমরা আছি।’
বক্তব্যের শেষাংশে জামায়াত আমির বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছা, শরীর আমাকে সাময়িকভাবে সহযোগিতা করেনি। এটাও আল্লাহর ইচ্ছা যে এখন আল্লাহ আমাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন। আমার মউত আল্লাহ-নির্ধারিত সময় থেকে এক সেকেন্ড আগে হবে না এবং হায়াত যা দিয়েছেন, তার এক সেকেন্ড আগেও আমি যাব না।’
বক্তব্য শেষে জামায়াত আমির নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়ান। তখন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে অনেকে যেমন অসুস্থ হয়েছেন, আমাদের আমিরে জামায়াতও সাময়িক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মহান আল্লাহতায়ালা তাকে কথা বলা ও সমাপ্ত ঘোষণার তৌফিক দিয়েছেন।’
এর আগে বাংলাদেশে সুশাসনের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে নতুন প্রজন্মের প্রথম ভোট দাঁড়িপাল্লায় চেয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে মজলুম সংগঠন জামায়াত। আর দলগুলোর মধ্যে আমরাই সম্ভবত বেশিরভাগ শহিদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি আল্লাহর রহমতে। আমরা একটি সুশাসনের রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই।’
পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল বা টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না বলে অনেকে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চান না মন্তব্য করে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জুলাইয়ের লড়াই-সংগ্রামের নতুন লক্ষ্য হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। ৫৪ বছরের শাসনের যে বাংলাদেশ, ৫ আগস্ট ছিল সেই বাংলাদেশের যে পরিচালনা, যে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যানের বিপ্লব। আমরা নতুন বাংলাদেশ চাই। যারা আবার পুরোনো কায়দায় এই দেশে পুরোনো শাসন ফিরিয়ে আনতে চায়, জনগণ তাদের সেই সুযোগ দেবে না।’
সমাবেশে ৭২-এর মুজিববাদী সংবিধানকে একপাশে রেখে কোনোদিন বাংলাদেশপন্থি বাংলাদেশ সম্ভব নয় দাবি করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘আমাদের নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে।’ সারজিস আলম বলেন, ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কিন্ত তার মানে এই নয় যে, আমরা অন্ধভাবে কারো দালালি করবো। কেউ যদি চাঁদাবাজি করে আমরা সেটা মুখের ওপরে বলব।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যার বিচার ছয় বছরেও না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তার বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আমার ছেলেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তার একমাত্র অপরাধ ছিল সে দেশের পক্ষে কথা বলেছিল। ভারতীয় আধিপত্য, আগ্রাসন এবং তৎকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের কিছু অবৈধ চুক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গণ-অধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, রক্তের বিনিময়ে যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন পেয়েছি, এ পরিবর্তনকে টেকসই করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ যে শাসনতান্ত্রিক এবং পরিবর্তনের আওয়াজ উঠিয়েছে; সেই শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না করে আপনারা নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না
জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস আহমাদ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
এ ছাড়া সমাবেশকে কেন্দ্র করে যানজটের কবলে পড়ে পুরো ঢাকা শহর। সরেজমিন দেখা গেছে, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট। একইভাবে রমনা থেকে মৎস্য ভবন হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তোপখানা রোড, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, দক্ষিণ দিকে চানখাঁরপুল এলাকায়ও দীর্ঘসময় যানবাহন সড়কে আটকে ছিল। কাকরাইল মোড় থেকে তেজগাঁও রোডেও ছিল এ যানজট। তবে শুধু রাজধানীর সড়কগুলোই নয়, মেট্রোরেলেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, টিএসসি, সচিবালয় স্টেশনে যাত্রীদের তীব্র চাপ। এতে স্বাভাবিক চলাচলে ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। যদিও এই সমাবেশকে ঘিরে যে শহরে তীব্র যানজট এবং ভোগান্তি হবে, সেই আশঙ্কা করে আগেভাগেই নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে নগরবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে জামায়াত।
কেকে/ এমএস