নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। এর মধ্যে কয়েকটি হত্যার ঘটনায় সেই বিরোধ তীব্র রূপ লাভ করে। বিশেষ করে মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যকাণ্ডের পর রাজনীতিতে সংঘাত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যদিও পরবর্তিতে সেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। তবে তার রেশ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে।
এরই ধারাবাহিকতা দেখা গেল গত বৃহস্পতিবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের কণ্ঠে। দুজনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে রাজনৈতিক বিরোধের সুর ফের স্পষ্ট ধরা দিয়েছে। এ ছাড়া পিআর পদ্ধতি নিয়েও বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন দুই দলের নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচন যারা চান, তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যারা বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চান, তারা স্থানীয় ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চান। পিআর পদ্ধতি খায় না মাথায় দেয়? কেউ বোঝে না।’
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে মহানগর উত্তর বিএনপির মৌন মিছিল কর্মসূচিতে তিনি এসব কথা বলেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ধরে রাখতে হবে। যারা নতুন নতুন বাক্যবিশারদ হয়েছেন, নতুনরা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেটা ভালো। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে, তবে তারা আবারও ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।’
এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেছেন, ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচনের কথা উঠলেই কেউ কেউ ভয় পায়। কারণ, এই পদ্ধতি চালু হলে চাঁদাবাজি, ভোট ডাকাতি, দলীয়করণ ও বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ যারা এর বিরোধিতা করছে, তারা আজও যৌক্তিকভাবে কোনো অসুবিধা তুলে ধরতে পারেনি। যে নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট, খুঁনি, চাঁদাবাজ তৈরি হয় এমন নির্বাচন বাংলাদেশে আমরা দেখতে চাই না।’ গতকাল এক দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা ইসলাম, দেশ ও মানবতার জন্য সংগ্রাম করছি। রাষ্ট্র সংস্কার ও গণহত্যার বিচার চাই। কিন্তু একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সাভারের একটি সমাবেশে রিজভী বলেন, ‘আমরা চেতনাবাহী এক ফ্যাসিস্টকে দমন করতে গিয়ে আবার ধর্মের নামে আরেকটা ফ্যাসিস্ট কড়া নাড়বে দরজায়, এটা তো হতে পারে না। এইটা তো জনগণ মেনে নেবে না। জনগণ এ দেশের ইতিহাসের সাক্ষী।’ ঢাকার ধামরাইয়ের শরীফবাগ এলাকায় ধামরাই উপজেলা ও ধামরাই পৌর বিএনপির আয়োজনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেন। বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও সদস্য নবায়ন কর্মসূচি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অশালীন প্রচারণার প্রতিবাদে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যারা মব কালচারের মধ্যে থাকে; ডাকাতি, রাহাজানি, চুরি, চাঁদাবাজির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক; তারা কেউ বিএনপির সদস্য হতে পারবে না। এ বিষয়টি আপনারা (স্থানীয় বিএনপির নেতারা) স্বচ্ছভাবে দেখবেন। সমাজে যারা শান্তিপ্রিয়, ভদ্র মানুষ, সজ্জন মানুষ, তারাই হবেন বিএনপির সদস্য।’ বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, সমাজের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ ভালো। চাঁদাবাজ, দখলদার, ডাকাত, চোর সংখ্যায় খুবই অল্প। কিন্তু তারাই গোটা সমাজ নষ্ট করে রাখে তাদের আধিপত্যের কারণে। তাই ভালো মানুষদের বিএনপির সদস্য করতে হবে।
ধামরাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি তমিজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ প্রমুখ।
এদিকে একই দিন ময়মনসিংহে দলীয় এক সমাবেশে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘এখন যারা রাজাকার গালি দিচ্ছে, ভবিষ্যতে জনতা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করবে।’ তিনি বলেন, ‘আগামীর লড়াই হবে হক বাতিলের মধ্যে। একদিকে চাঁদাবাজের গোষ্ঠী আর একদিকে থাকবে চাঁদা ফেরানোর গোষ্ঠী। একদিকে থাকবে জালিমের গোষ্ঠী, ভারতের দালালপন্থি গোষ্ঠী, অন্য একদিকে থাকবে জালিম বন্ধ করার গোষ্ঠী ও দেশপ্রেমিক জনতা।
ছাত্র-জনতাকে রাজাকার গালি দেওয়ায় শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এখন যারা রাজাকার গালি দিচ্ছে, ভবিষ্যতে জনতা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করবে। আমি জনতার উদ্দেশে হাতজোড় করে বলতে চাই, একবার ইসলামের পক্ষে ভোট দেন। দেখেন, যদি আপনাদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ হয়, তাদের বিতাড়িত করবেন।’
গত বৃহস্পতিবার বিকালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে সিঅ্যান্ডবি মাঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা শাখা আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফয়জুল করীম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উদ্দেশে বলেন, ‘আগে গণতন্ত্র কী শিখুন, জানুন। পরে সমালোচনা করুন। বিরোধী দলের কাজই হবে গঠনমূলক সমালোচনা, অন্যায় ধরিয়ে দেওয়া। আপনারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানকার সরকারি দল, বিরোধী দল কী ধরনের সমালোচনা করে, ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়। আমি বিএনপির মহাসচিবকে আহ্বান জানাতে চাই, ইসলামী দলের কারা চাঁদাবাজি করে, ধর্ষণ করে, খুন করে, মিথ্যা কথা বলে, মাদক সেবন করে ধরিয়ে দিন। আপনারা মিথ্যা অপবাদ না দিয়ে নিজেদের সংশোধন করে অন্যদের সমালোচনা করুন।’
ইসলামী আন্দোলনের এ নেতা বলেন, ‘শেখ হাসিনার বাহিনী নিজেদের পাহাড়ের চেয়ে শক্তিশালী মনে করত। তারা কিন্তু নাই, পালিয়ে গেছে। আপনারা বলেন, আপনারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা অথচ আপনারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। শাহ আজিজুর রহমানের মতো চিহ্নিত ও সবচেয়ে বড় রাজাকারকে জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। অথচ বিএনপি স্লোগানে স্লোগানে রাজাকার বলে গালি দেয়। যে স্লোগান ছিল আওয়ামী লীগের, সেই স্লোগান এখন বিএনপি দেয়। যে স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়েছে, সেই স্লোগান দিয়ে বিএনপিও ধ্বংস হবে। শেখ হাসিনার এক রাজাকারের বাচ্চা বলায় মসনদ ধ্বংস হয়ে গেছে, সে ধ্বংসের স্লোগান আপনারা দিয়েন না।’ ফয়জুল করীম আরো বলেন, ‘আপনারা সতর্ক হোন। জনগণ আপনাদের চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ বলছে।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা সভাপতি মাওলানা মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে ত্রিশাল উপজেলা সভাপতি মাওলানা ইব্রাহিম খলিল উল্লাহর সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা নুরুল করীম আকরাম, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক অধ্যাপক ডা. নাছির উদ্দিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ময়মনসিংহ মহানগরের নায়েবে আমির আসাদুজ্জামান সোহেল, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ত্রিশাল উপজেলার আমির মাওলানা আবু তাহের প্রমুখ।
কেকে/ এমএস