বিষমুক্ত মাছ চাষে বাণিজ্যিক মৎস্য খাবারের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ বান্ধব কালো সৈনিক পোকা চাষ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নওগাঁতে প্রথমবারের মতো কালো সৈনিক পোকার খামার সম্প্রসারণে পিকেএসএফ এর কারিগরি সহযোগিতায় আরএমটিপি প্রকল্পটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা মৌসুমী বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যেই অধিক আমিষ সমৃদ্ধ এ পোকাটি চাষ করে নিজের পুকুরে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছেন এবং প্রতি মাসে উদ্বৃত্ত এই পোকা বিক্রি করে অর্ধলক্ষ টাকা আয় করছেন মৎস্যচাষি আহসান হাবীব।
প্রতিনিয়তই হাবীবের খামার দেখতে উলিপুর গ্রামে ভীড় করছেন আগ্রহীরা। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে এলাকায় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে এবং ছোটো ও মাঝারি আকারে খামার গড়ে উঠছে। বর্তমানে হাবীব এলাকায় পোকা চাষি নামে পরিচিতি পেয়েছেন এবং বেকার যুবকদের কাছে এক দৃষ্টান্তর স্থাপন করেছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ পোকা চাষ দ্রুতই জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করছেন জেলার মাছচাষিরা।
নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. আহসান হাবিব জানান কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি পুকুরে মাছ চাষও করেন। এক সময় তিনি মাছকে ফিড খাওয়াতে গিয়ে বড় ধরনের লোকসানে পড়েন। এরপর তিনি ইউটিউবে ভিডিও দেখে ২০১৯ সালে মাছের খাবারের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব কালো সৈনিক পোকা উৎপাদনের জন্য খামার তৈরী করেন। প্রথম দিকে খামার হতে মাসে ১-১.৫ মণ লার্ভা উৎপাদন হতো। পরবর্তিতে ২০২৪ সালে তিনি মৌসুমী আরএমটিপি প্রকল্প হতে খামার সম্প্রসারণের আর্থিক সহায়তা প্রাপ্ত হন এবং বড় আকারে খামার স্থাপন করেন। তিনি বর্তমানে প্রতি মাসে তার খামারে ৪-৪.৫ মণ লার্ভা উৎপাদন করছেন।
নিজের পুকুরে মাছের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রতি মাসে তিনি এই পোকা বিক্রি করে ৫০হাজারের বেশি টাকা আয় করছেন। মাছের বিকল্প হিসেবে আমিষ সমৃদ্ধ এ পোকা মাছের খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে ৫০-৬০% খরচ সাশ্রয় করতে সক্ষম হচ্ছেন হাবীব। এই পোকা উৎপাদনে আলাদা কোন খাবারের প্রয়োজন হয় না। এই পোকার খাদ্য হচ্ছে বাড়ি, হোটেল ও বাজারের উচ্ছিষ্ট এবং আবর্জনা। তাই একদিকে ময়লা, আবর্জনা এবং উচ্ছিষ্ট ব্যবহারে রিসাইকেলের মাধ্যমে পরিবেশ যেমন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে তেমনি ভাবে মাছ চাষে খাবারের বিকল্প হিসেবে এই পোকা ব্যবহারে খরচ কমছে অনেকাংশ। ফলে বিষমুক্ত মাছ চাষে লাভবান হচ্ছেন মৎস্য চাষীরা। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি আগামীতে এই পোকার শুকনো পাউডার তৈরি করে ফিডের মতো ব্যবহার করার কার্যক্রমও শুরু করবেন।
উলিপুর গ্রামের আরেক মাছ চাষি রাজা জানান তিনি এবার ৫বিঘার একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেছেন। মাছের খাবারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় খরচ অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। অথচ হাবীব কালো সৈনিক পোকা চাষ করে ব্যাপক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। নিজের চাহিদা পূরণের পর বাহিরে বিক্রি করে হাবীব আর্থিক ভাবেও লাভ হচ্ছেন। তাই মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে তিনিও কালো সৈনিক পোকা চাষ শুরু করবেন।
জেলার বদলগাছী উপজেলার মাছ চাষি রফিকুল ইসলাম জানান বিষমুক্ত মাছ চাষ করতে বিশেষ করে কার্প জাতীয়, দেশী শৈল মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষে অধিক লাভবান হতে হলে পরিবেশবান্ধব এই কালো সৈনিক পোকা চাষের কোন বিকল্প নেই। আগামীতে তিনি হাবীবের সহযোগিতা নিয়ে এ পোকার চাষ শুরু করবেন।
মৌসুমী আরএমটিপি প্রকল্পের কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন বলেন, জেলায় এ প্রথম আগ্রহী মাছ চাষিদের মাধ্যমে কালো সৈনিক পোকা চাষের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চাষীদের মাছ চাষে অধিক লাভবান করতে ও ভোক্তাদের মাঝে বিষমুক্ত মাছ পৌছে দিতেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতে এ প্রকল্পটি আরো বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
নওগাঁ সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. বায়েজিদ আলম বলেন শতভাগ পরিবেশ বান্ধব এই কালো সৈনিক পোকার অনেক উপকারী দিক রয়েছে। প্রথমত এ পোকার খাবার হচ্ছে ফেলে দেওয়া বাড়ির উচ্ছিষ্ট, ময়লা আর আবর্জনা। ফেলে দেয়া এই ডাস্টগুলো রিসাইকেল হতে যে ক্ষতিকর গ্রীণ হাউজ গ্যাস নি:সরণ ঘটে সে গ্যাসও এই পোকা শোষণ করে। মাছ চাষি ও ভোক্তাদের মাঝে এই পোকার উপকারী দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ভোক্তাদের এই পরিবেশবান্ধব পোকার মাধ্যমে বড় হওয়া মাছ নিয়ে পজেটিভ ধারণা গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারী ভাবেও আগ্রহীদের এ পোকা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণার মাধ্যমে ফিডের মতো করে এই পোকার পাউডার তৈরি করে বাজারজাত করতে পারলে চাষিদের মাছ চাষে খরচ কমার পাশাপাশি দেশের ভোক্তাদের কাছে বিষমুক্ত মাছ পৌছে দেওয়া সম্ভব হতো।
কেকে/ এমএস