সময় থেমে থাকে না। প্রতিটি দিন এগিয়ে চলে নিজস্ব গতিতে, নিয়ে আসে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন মানুষ। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে থেকে যায় কিছু অমূল্য মুহূর্ত, কিছু চিরচেনা মুখ, কিছু অনুভূতি—যা কখনো স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায় না।
স্কুলজীবন ঠিক তেমনই এক অধ্যায়। যেখানে গড়ে ওঠে জীবনের প্রথম বন্ধুত্ব, ধরা দেয় প্রথম স্বপ্ন, আর জমে ওঠে হাজারো হাসি-কান্নার গল্প।
আমি অন্তর। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা খাসেরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি ২০১৭ ব্যাচের ছাত্র। স্কুল ছেড়েছি প্রায় নয় বছর। এই নয় বছরে জীবনের পথে বহু বাঁক পেরিয়েছি, পেয়েছি নানা অভিজ্ঞতা। কিন্তু ২০২৫ সালের ঈদুল আজহা আমাদের জন্য নিয়ে এলো এক অনন্য উপলক্ষ্য।
আমরা সেই প্রিয় স্কুলের সহপাঠীরা আবার একত্রিত হলাম প্রিয় সেই স্কুল প্রাঙ্গণে। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত হলো বিদায় সংবর্ধনা ও ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান।
এটি ছিল শুধু একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন নয়, বরং ছিল ফেলে আসা দিনগুলোকে একটিবার আবার ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা। সারা দিনের আয়োজনে বারবার মনে হচ্ছিল আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই সময়টায়। ছোট্ট অন্তর হয়ে উঠেছি আবার। বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস শেষে দুষ্টুমিতে মেতে উঠছি, গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছি, কিংবা হঠাৎ হঠাৎ কারো পিঠে আলতো চাপড় দিচ্ছি। এমনই কতশত হিরণ্ময় স্মৃতিরা মনের মণিকোঠায় বরাবর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।
আমার স্কুলজীবনের কিছু স্মৃতি আজও আমার মনকে নাড়িয়ে দেয়। হৃদয়কে আন্দোলিত করে তোলে। মনে পড়ে, আমার বন্ধু আজিম প্রতিদিন সকালে এসে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যেত আমাকে। আমরা একসঙ্গে আনন্দে-আবহে টিফিন ভাগ করে খেতাম। আজিম, আসিফ, জহির আর আমি মিলে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম পুরো এলাকা। সেই স্বাধীনতা, সেই উচ্ছ্বাস, আজও অনুভব করি গভীরভাবে। যেন তখন মুক্ত বিহঙ্গ ছিলাম।
ভোলানাথ স্যার ছিলেন আমাদের গণিতের শিক্ষক। আমরা যারা পেছনের সারিতে বসতাম, তারা একটু কম পারতাম। স্যার আমাদের ওপর রেগে যেতেন প্রায়ই। এখন বুঝি তার সেই রাগের আড়ালে ছিল অপার ভালোবাসা।
লাকি ম্যাডাম আমাদের ইংরেজির শিক্ষক। মুখস্থ না করতে পারলে কঠোর হতেন, শাস্তিও দিতেন। কিন্তু সেই শাস্তির মাঝেও ছিল একজন শিক্ষকের অকুণ্ঠ আন্তরিকতা। আর স্নেহভরা ভালোবাসার ছোঁয়া।
আর কল্পনা ম্যাডামের বাংলা ক্লাসগুলো ছিল যেন গল্পের জাদুঘর। প্রতিটি ক্লাসে মনে হতো আমি কোনো এক নতুন জগতে প্রবেশ করছি।
অনেকের সঙ্গে দেখা হলো প্রায় ৭–৮ বছর পর। তবু একটুও অচেনা লাগেনি কারো। মুখে বয়সের ছাপ এলেও চোখে ছিল সেই চিরচেনা ঝলকানি। কেউ এখন চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা উচ্চশিক্ষায় ব্যস্ত; কিন্তু সবার পরিচয় আজও একই—আমরা সেই স্কুলজীবনের পুরোনো বন্ধু।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের অনেক প্রিয় শিক্ষক। যাদের একসময় মনে হতো, ‘স্যার তো সব জানেন।’ সেই স্যাররাও আজ কেউ অবসরপ্রাপ্ত, কারো চুল পেকে গেছে, কারও কণ্ঠে সময়ের ক্লান্তি। তবুও তাদের চোখে আজও যে দীপ্তি—তা আমাদের পথচলার চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
অনুষ্ঠানে ছিল অভিজ্ঞতা বিনিময়, স্মৃতিচারণ, উপহার ও ক্রেস্ট প্রদান, ছবি তোলা, খাবার পরিবেশন, আর সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত ছিল শিক্ষকদের বিদায় সংবর্ধনায় সম্মান জানানো। যখন স্যারদের হাতে ফুল আর ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছিলাম, তখন কারো কারো চোখে জল চিকচিক করছিল। সেই মুহূর্তটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
স্কুলের সেই পাঁচটি বছর ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি এখানে শুধু পাঠ্যবই পড়িনি, শিখেছি বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আর স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। এই বিদ্যালয়ই আমার ভিত গড়ে দিয়েছে, আমাকে আজকের আমিতে রূপান্তর করেছে।
আজ আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি—সময় বদলায়, জীবন এগোয়, কিন্তু স্কুলের স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পাতায় অমলিন থেকে যায়।
আমার প্রিয় সহপাঠীরা, প্রিয় শিক্ষকরা, আমার সেই প্রিয় বিদ্যালয়—আমি তোমাদের কখনো ভুলব না। ভালোবাসি সবাইকে। সত্যিই, অনেক অনেক ভালোবাসি।
কেকে/এএম