একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার শহরের অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে। সেই সময় শাহ মোস্তফা রোডের বেরি লেকের দক্ষিণ পাড়ে তাদের কয়েকজনকে গণকবর দেওয়া হয়। কিন্তু এই গণকবরটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে ছিল অযত্ন আর অবহেলায়। দুর্গন্ধে এলাকাবাসীও চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হতেন।
২০১০ সালে মৌলভীবাজার পৌরসভা শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও আশপাশের পরিবেশ রয়ে যায় নোংরা ও বেহাল। এই ময়লার ভাগাড়টি বদলে দেন জাহাঙ্গীর হোসেন ও ছইফুল ইসলাম নামে দরিদ্র দুই রিকশা চালক। ২০১৬ সালে এই দুই বন্ধু নিজ উদ্যোগে ও অর্থায়নে সেখানে গড়ে তোলেন এক মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান। ময়লা পরিষ্কার করে, চারা কিনে, নিয়মিত পানি দিয়ে এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তারা প্রায় ১০ বছর ধরে বাগানটি টিকিয়ে রেখেছেন।
ছাইফুল ভান্ডারী বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর পূর্বে কাজের সন্ধানে মৌলভীবাজারে আসি। এর কিছুদিন পর জাহাঙ্গীর ভান্ডারীও মৌলভীবাজারে আসলে আমাদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। রিকশা চালানোর পাশাপাশি আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে বাদাম ও ঝালমুড়ি বিক্রি করে আসছি। বেরি লেকের উল্টো পাশে রাস্তায় বসে আমরা যখন বাদাম আর ঝালমুড়ি বিক্রি করি তখন দেখতে পাই মহান মুক্তিযোদ্ধে সাত শহীদের গণকবরটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আশপাশের বাসা-বাড়ির বাসিন্দারা এখানে ময়লা ফেলছেন। এছাড়া এ স্থানটি প্রস্রাবখানায় পরিণত হয়েছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। তখন আমরা চিন্তা করি কি করা যায়। সে চিন্তা থেকেই এ গণকবরের স্থানটি পরিস্কার করে ২০১৬ সালে সেখানে ফুলের বাগান তৈরির কাজ শুরু করি।
তিনি আরও বলেন, নিজেদের দৈনিক আয় থেকে স্থানটি পরিস্কারের ব্যয় ও ফুলের চারা কেনায় কিছু টাকা খরচ করি। প্রথম দিকে ১০টি গাঁধা ফুলের চারা রোপন করলেও পরে ধীরে ধীরে বাগানটি বর্ধিত করা শুরু করি। রোপন করি বিভিন্ন জাতের গোলাপ, জবা, গন্ধরাজসহ কয়েক জাতের ফুলের গাছ। বর্তমানে বাগানে ১৫ জাতের গোলাপ, ৪ জাতের জবা, গন্ধরাজ, কামিনী, ডালিয়া ফুলের প্রায় অর্ধশতাধিক গাছ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আমড়া, বরই, নিম ও কাঁঠালের মতো গাছ।
জাহাঙ্গীর জানান, নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সত্ত্বেও তারা দমে যাননি। কেউ কেউ বলতেন, ভাত খেতে পারে না, আবার বাগান করব—বাগান। তবু তারা তাদের দৃঢ় সংকল্প থেকে পিছু হটেননি।
পঞ্চাশ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থেকে এবং সমবয়সী ছাইফুল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে এসেছেন মৌলভীবাজারে। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ধরে দুইজনেই বসবাস করছেন মৌলভীবাজার শহরের দরগা মহল্লা (সুলতানপুর) এলাকায়। দিনের বেলা রিকশা চালানো এবং সন্ধ্যায় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বাদাম বিক্রি করা ছাইফুলের পেশা। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর রিকশা চালানোর পাশাপাশি ঝালমুড়ি ও চটপটি বিক্রি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোন রকমে দিনানিপাত করলেও, তাদের হৃদয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট।
বাগানের ব্যয়ভার তারা নিজেদের সামান্য আয়ের মধ্য থেকেই বহন করেন। ফুলের চারা, কীটনাশক, পানি—সবকিছুতেই রয়েছে তাদের শ্রম ও ত্যাগ।
বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন তাদের একবার মাত্র ১০ হাজার টাকা সহায়তা করেছেন। তবে এখনো কোনো সরকারি বেতন বা নিয়মিত অনুদান পান না তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা তাদের এ উদ্যোগকে ব্যতিক্রমী বলে উল্লেখ করেছেন। একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, এতো দারিদ্র্যেও তাদের মন ও চেতনা এত বিশাল—এটা আমাদের গর্বের বিষয়।
এই দুই রিকশাচালক যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিঃশব্দ সৈনিক। তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ থাকলে অল্প সামর্থ্যেও বদলে দেওয়া যায় ইতিহাসের অবহেলিত এক কোণ।
কেকে/এজে