আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলন দমাতে সশস্ত্র হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ক্যাডার ও ইসকন সদস্যসহ সাতজনকে তিনধাপ ডিঙিয়ে পাঁচধাপ উচ্চপদে স্থায়ীভাবে পদোন্নতি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। গত কয়েকদিন পূর্বে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ হতে এই পদোন্নতির ফাইল প্রস্তুত করে সংস্থাটির শীর্ষ কর্তাদের বরাবর পাঠিয়েছেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমরান হোসেন রানা। যা বর্তমানে প্রধান নির্বাহীর দফতর হয়ে মেয়রের টেবিলে রয়েছে। যে কোনো সময় সিটি মেয়রের স্বাক্ষর হলেই চসিক সচিব পদোন্নতিপত্র ইস্যু করবেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
যদিও স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ সদ্য স্থায়ী হওয়ার আগেই সরকারি নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে গোপন চুক্তিতে পাঁচধাপ উচ্চপদে এ সাতজনকে স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে সংযুক্তিতে পদায়ন করা হয়। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে-জামাতা চসিকের সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সচিবালয় বিভাগের কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে সাত অস্থায়ী সহকারীকে ২০১৯ সালে সরাসরি স্বাস্থ্য পরিদর্শকের পদে বসিয়ে দেন। এরপর থেকেই স্বাস্থ্য পরিদর্শক পরিচয়ে এসব স্বাস্থ্য সহকারী প্রি-মিসেস ও ফিটনেস সনদের নামে নগরীর বিভিন্নস্থানে খাদ্য উৎপাদন এবং বিপণন প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে।
অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত অন্তত অর্ধশত অস্থায়ী স্বাস্থ্য সহকারীর নিয়োগ স্থায়ী করা হয়েছে গত বছর ১ এপ্রিল (০১.০৪.২০২৪)। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর এসব স্বাস্থ্য সহকারীর চাকরিকাল অতিবাহিত হয়েছে মাত্র নয় মাস। এরমধ্যেই তাদের মধ্য হতে সুমন মিত্র, তাপদ দে, শেখ শহিদুল আলম, আবু তাহের, এরশাদুল ইসলাম, সলিমুল্লাহ তালুকদার ও আবু জাফর নামে সাত স্বাস্থ্য সহকারীকে তিনধাপ ডিঙিয়ে পাঁচধাপ উচ্চপদে পদোন্নতি নিয়ে দেওয়ার জোরপ্রচেষ্টা শুরু করেছেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমরান হোসেন রানা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই ইসকন সদস্য ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ পদধারী।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চসিকের পদোন্নতির জন্য প্রস্তাবিত এই তালিকায় থাকা সুমন মিত্র রয়েছে ভারতীয় উগ্রবাদী জঙ্গিসংগঠন ইসকানের পটিয়া উপজেলার নেতৃত্বে। একই সঙ্গে নগরের জামাল খান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমনের সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরের আসকার দিঘীর পাড় এলাকায় রামদা নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। এর আগে নগরীর ইসলামিয়া কলেজ এলাকায় যুবলীগের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিউ মার্কেটের সমাবেশে সশস্ত্র হামলা চালায় ইসকন নেতা সুমন। একইভাবে সক্রিয় ইসকন সদস্য ও যুবলীগ ক্যাডার তাপস দে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় (চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর) তাণ্ডবে সরাসরি অংশ নেয়।
বোয়ালখালী পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ শহিদুল আলমও ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সশস্ত্র গ্রুপ নিয়ে মাঠে নামেন। ওই সময় বোয়ালখালী, মুরাদপুর, চান্দগাঁও ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রসহ বিভিন্ন রসদ জোগান দেন। এর আগে তার বিরুদ্ধে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কয়েক করার অভিযোগ করেন স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
বোয়ালখালী থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) গোলাম ছারওয়ার জানান, শেখ শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সশস্ত্র হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে থানায় চারটি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের প্রচেষ্টা চলছে।
চসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগকে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন তারা। তবে এমনসব ফৌজদারী অপরাধসহ সরকারি চাকরি ও বিধি ভঙ্গ অপরাধে জড়িত এসব স্বাস্থ্য সহকারীকে গোপন চুক্তিতে পাঁচধাপ উচ্চপদে পদোন্নতি পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সংঘবব্ধ একটি চক্র।
যদিও সরকারের চাকরি বিধি অনুসারে এই পদে পদোন্নতি পেতে হলে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ স্থায়ী হওয়ার পর চারটি ধাপে অন্তত ২০ হতে ২৫ বছর চাকরিকাল অতিবাহিত হওয়াসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ কোর্স সম্পন্ন ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে গত নয় মাস পূর্বে (১ এপ্রিল ২০২৪) নিয়োগ স্থায়ী হওয়া এই সাত স্বাস্থ্য সহকারীর পদোন্নতিতে সরকারের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি বিধির কোনো নিয়মই অনুসরণ করেননি (মানেননি) চসিকের সংশ্লিষ্ট কর্তারা। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
চসিকের সংস্থাপন শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ (চাকরি) স্থায়ী হয়ে অন্তত পাঁচ বছর চাকরি করার পর সিনিয়র স্বাস্থ্য সহকারী পদে পদোন্নতি হওয়ার কথা। এ পদে শান্তি-শৃঙ্খলা মেনে পাঁচ বছর চাকরিকাল অতিক্রম করার পর পদোন্নতি পাবেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে। এরপর নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক (এসআইটি)সহ আরো কয়েকটি কোর্স সম্পন্ন করার পাশাপাশি চাকরিকাল পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাবেন। এরপর সিনিয়র স্বাস্থ্য পরিদর্শক এবং স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
চসিক সচিবের দফতর সূত্র জানায়, গত আট মাস পূর্বেও এসব স্বাস্থ্য সহকারীকে নিয়োগকাল এক মাস না যেতেই গোপন চুক্তিতে পাঁচধাপ উচ্চ পদে (স্বাস্থ্য পরিদর্শক) পদোন্নতি নিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায় সংঘবব্ধ চক্র। সে সময় বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তাদের এ অপচেষ্টা ভেস্তে যায়। কিছুদিন চুপ থেকে আবারও সেই অবৈধ পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে এই বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমরান হোসেন রানা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সাত স্বাস্থ্য সহকারীকে তিন ধাপ ডিঙিয়ে পাঁচ ধাপ উচ্চপদে পদোন্নতির তোড়জোড়ের বিষয়ে জানতে চসিক সচিব মোহাম্মদ আফরাফুল আমিন বলেন, এ ধরনের কোনো পদোন্নতির ফাইল আমার টেবিলে এসছে জানা নেই। আর এ ধরনের পদোন্নতির সুযোগও নেই। তিনি বলেন, পদোন্নতি দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বোর্ড রয়েছে। বোর্ড সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞা যাচাইপূর্বক প্রার্থী নির্বাচন করে তালিকা দেবে। এরপর মেয়র মহোদয়ের সুপারিশে ক্রমে পদোন্নতি পেতে পারে। কিন্তু এর বাহিরে গিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরাসরি সচিবালয় শাখার মাধ্যমে মেয়রের দফতরে ফাইল উত্থাপন করে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে চসিক সচিব বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বোর্ড অচল। মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেছি, যাতে পদোন্নতি বোর্ড সচল যোগ্য লোকগুলোকে পদোন্নতি দেওয়া যায়। এরমাধ্যমে সিটি করপোরেশনের সেবার গতি বৃদ্ধি পাবে। এর আগে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের কোনো ফাইল আমার টেবিলে এসেছে কিনা জানা নেই। বিধি উপেক্ষা করে কোনো নিয়োগ-পদোন্নতি অন্তত আমার হাতে হবে না- এটা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
কেকে/এআর