কয়েক দিনের টানা অবরোধ করার পর গতকাল সোমবার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ। শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে নগরবাসী। তাদের প্রশ্ন, শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে কেন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে হবে। রাস্তা বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়া লোকজনের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবশেষে কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জনগণই শিক্ষার্থীদের সরাবে বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা জনগণকে অতিষ্ঠ করে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে তিনি বলেন, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা জনগণকে অতিষ্ঠ করে ফেলছে। জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে আন্দোলনে জনগণের নাভিশ্বাস, আমাদেরও নাভিশ্বাস। তিনি আরো বলেন, অতিষ্ঠ জনগণই শিক্ষার্থীদের রেললাইন থেকে উঠিয়ে দেবে। এ সময় তিনি রাস্তা ছেড়ে ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানানোর আহ্বান জানান।
শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান তথ্য উপদেষ্টার
এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, তিতুমীর কলেজের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল সরকারি তিতুমীর কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, তাদের শিক্ষাজীবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে এ সরকার দায়িত্বশীল। এ মুহূর্তে হয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনভোগান্তি যেন না হয়, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। আশা করি ভালো কিছু হবে।
রেললাইন অবরোধে শিডিউল বিপর্যয়
তবে সরকারের কোনো আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছেন না তিতুমীর কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তারা মহাখালী রেলক্রসিং এলাকা অবরোধ করেন। এ সময় ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থীদের একটি দল মিছিল নিয়ে রেলক্রসিংয়ে অবস্থান নেন। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় রেললাইনেই কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস আটকে যায়। এ ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে অনেক ট্রেন।
এতে গতকাল সন্ধ্যায় ৭টা পর্যন্ত ১৫টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ঢাকা বিভাগ) মহিউদ্দিন আরিফ বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অন্তত ১৫টি ট্রেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে।
অবরোধে ভোগান্তিতে ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ
এ দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ওই এলাকায় ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে জলকামান। এ ছাড়া তাদের অবরোধের কারণে মহাখালী থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এর আগে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ১২টার পর গুলশান লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা সড়কের ওপর বাঁশ ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন।
জাহাঙ্গীর গেট থেকে মহাখালী যাওয়ার রাস্তা বন্ধ থাকায় এই পথে চলাচল করা হাজারো মানুষ হেঁটে চলাচল করছেন। কেউ শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে, কেউ মালামাল হাতে নিয়ে হাঁটছেন। সাইকেল, মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষ ভোগান্তিতে ক্লিষ্ট।
রাজধানীর মিরপুর থেকে বাড্ডা যাচ্ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। হাতে মালামাল নিয়ে মহাখালী রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় গণমাধ্যমকে বলেন, বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে বাস থেকে নেমেছি। সেখান থেকে মালামাল হাতে নিয়ে হেঁটেই যেতে হচ্ছে।
ময়মনসিংহ থেকে আসা মনোয়ারা বেগম নামের এক নারী বলেন, বাসে এসে মহাখালীতে নেমেই দেখি রাস্তা বন্ধ। তাই ব্যাগ কাঁধে নিয়েই হাঁটতে হচ্ছে। বাস কোথা থেকে পাব, আর কীভাবে যাব তা জানি না।
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। অবরোধ চলাকালীন অ্যাম্বুল্যান্স ও রোগী পরিবহনের গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি চলতে দেবেন না। এদিকে দাবি আদায়ে ১০ জন শিক্ষার্থী গত পাঁচ দিন ধরে তিতুমীর কলেজ গেটের সামনে অনশন করছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার
আগামী সাত দিনের মধ্যে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে সরকার পদক্ষেপ নেবে এমন আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাত ১০টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. নুরুজ্জামান, কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শিপ্রা রানী মণ্ডলের উপস্থিতিতে তারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এ সময় অধ্যক্ষ অনশনরত শিক্ষার্থীদের জুস পান করান শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা বলেন, সরকার আগামী সাতদিনের মধ্যে সরকারি তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেবে এমন আশ্বাস দিয়েছেন যুগ্মসচিব মো. নুরুজ্জামান। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমরণ অনশন, অবরোধসহ সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বেশ কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে মিছিল, সড়ক-রেলপথ অবরোধ, স্মারকলিপি প্রদান, ক্লাস বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করতে শিক্ষ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। তবে সম্প্রতি এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পেয়ে গত ২৯ জানুয়ারি বিকেল থেকে দাবি আদায়ে আমরণ অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
কেকে/এআর