দেশে বিভিন্ন পেশায় নারীরা যুক্ত থাকলেও তাদের কাজের স্বীকৃতি, শ্রমের মূল্যায়ন থাকে উপেক্ষিত। উল্টো পদে পদে তাদের জন্য অপেক্ষা করে নানা অপবাদ, কুৎসা,বঞ্চনা। এ মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রান্তিক নারী কৃষক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির কারণে বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত নরী কৃষক। দুঃখজনক হলেও স্যু, প্রান্তি নারী কৃষক সংসার এবং কৃষি কাজ একসঙ্গে সামলালেও তাদের জীবনে না আছে সুখ-শান্তি, না আছে কাজের স্বীকৃতি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মক্ষম মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী কৃষক। এ অবস্থার দ্রুত অবসানে প্রয়োজন নারী কৃষকদের পেশা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি, কৃষি কার্ড, স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রসঙ্গত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ও নদীভাঙনে কৃষি উৎপাদন, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। দেশের কৃষিক্ষেত্রে নারীদের অবদান অপরিসীম। তারা বীজ সংরক্ষণ, চারা রোপণ, ফসল সংগ্রহ, খাদ্য সংরক্ষণ ও গৃহপালিত পশুর লালন পালনসহ কৃষির প্রায় প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তবুও, জলবায়ু অভিযোজন ও নীতি প্রণয়নে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো অপ্রতুল। প্রান্তিক নারী কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিক্রিয়া বোঝার ও কার্যকর অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অপরিহার্য। জাতীয় পর্যায়ে অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণে নারী কৃষকদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
উপকূলীয় অঞ্চলে দেশের মোট ভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং জনসংখ্যার প্রায় ২৮% মানুষের আবাস স্থল জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। ঘূর্ণিঝড়, জলোছ¡াস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন ও অনিয়মিু বৃৃষ্টিপাত এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ক্রমেই অনিশ্চিত করে তুলছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য, উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে ৩ থেকে ৪ মিলিমিটার বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলগুলোতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এতে কৃষিজমি, পানীয় জল ও পশুখাদ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। একসময় যে অঞ্চলে তিন ফসল উৎপন্ন হতো, সেখানে এখন অনেক ক্ষেতেই এক মৌসুমে লবণসহিষ্ণু ধান ছাড়া অন্য ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। নারী কৃষক, যারা বীজ সংরক্ষণ, চারা রোপণ ও গৃহস্থালি খাদ্যব্যবস্থাপনায় মুখ্য ভূমিকা রাখেন তাদের শ্রম ও আয় দুই-ই কমে যাচ্ছে। পানি সংগ্রহ, বিকল্প জীবিকা খোঁজা ও পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের বাড়তি চাপও তাদের ওপর পড়ছে।
অবশ্য জলবায়ু ঝুঁকি নিরসনে সরকার বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্লান, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্লান, ও ডেল্টা প্লান ২১০০ গ্রহণ করেছে। তবে এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। কারণ পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক অর্থায়নের অভাব, প্রযুক্তি হস্তান্তরে বিলম্ব, এবং স্থানীয় বাস্তবতাভিত্তিক অভিযোজন বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা। দেশের জলবায়ু নীতিতে নারীর নিরাপত্তা, অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মপরিকল্পনায় নারীদের বিশেষ ঝুঁকি, জীবিকা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সুরক্ষার কথা উল্লেখ আছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, নিরাপদ আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, পানি ও স্যানিটেশন সুবিধায় নারীদের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে অবকাঠামো ও বাজেট বাড়াতে হবে। উপকূলীয় ও নদীভাঙন অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্রে আলাদা ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ও মাতৃত্বসেবার ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নারী কৃষকদের প্রযুক্তি, তথ্য, জলবায়ু সহনশীল বীজ, ঋণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। এ জন্য ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের লক্ষ্য পূরণে স্থানীয় পর্যায়ে নারী কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে তাদের অংশগ্রহণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সর্বোপরি লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ, মনিটরিং ও বাজেট বরাদ্দ নিদ্দিষ্ট করে নির্ধারণ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে নারীর চাহিদা উপেক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে প্রদত্ত নীতি সহায়তা নারীদের নাগালে পৌঁছাবে।
প্রসঙ্গত, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী কৃষকরা। এমনকি তাদের প্রজনন স্বাথ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা কৃষি উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও পশুপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ও বাজার সুবিধা এখনো সীমিত। সরকারি বাজেটে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কিছু বরাদ্দ থাকলেও তা মূলত প্রশিক্ষণ, সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষিঋণ প্রাপ্তিতে অপ্রতুল। বাস্তবে এ বরাদ্দের অধিকাংশই উপকূলীয় নারী কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নারী কৃষকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেন। তারা লবণসহিষ্ণু ধান ও সবজি চাষ, উঁচু বেডে, ভাসমসান পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ছাদের বাগান, বীজ সংরক্ষণ এবং হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষের মতো বিকল্প জীবিকা অনুসরণ করছেন। কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তারা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত।
বাজেট প্রণয়নে নারী কৃষকদের অন্তর্ভুক্তর বিষয়টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা হলেও বাস্তবে প্রতিফলন নেই। ফলে নারী কৃষকরা কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাদের কাজকে স্বীকৃতি ও সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, ২০১৩ সালে ভূমির ওপর পুরুষের মালিকানা ৯৬ দশমিক ৫২ এবং নারীদের ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য থাকলেও কিষানিদের কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য নেই। গণ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের মাধ্যমে কৃষক কার্ডের ব্যবস্থা করা হলেও তা থেকে নারীরা বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষক হিসেবে নারীদের স্বীকৃতি না থাকায় চারটি ক্ষেত্রে তারা প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রথমত: আর্থিক ও প্রযুক্তি, দ্বিতীয়ত খাসজমি লিজ না পাওয়া, তৃতীয়ত সরকারি প্রণোদনা এবং চতুর্থত যথাযথ মজুরি না পাওয়া। তবে নারীদের সক্রিয়ভাবে কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করলে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি কমবে ১২-১৭ শতাংশ।
সর্বশেষ ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনে ১.৫৭ মিলিয়ন নারীকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৬ লাখ ২১ হাজার ২০ নারীকে উচ্চফলনশীল কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং ও আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে কৃষিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের বাণিজ্যিক কৃষি কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে নারীরা কৃষিতে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বসুবাড়ির আঙিনায় ও আশপাশে ফল উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালনে উৎসাহিত করার কারণেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
বাংলাদেশে কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৫০% নারী হলেও তারা ‘কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। তারা জমির মালিক না হওয়ায় সরকারি ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ, বিমা বা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তারা বেশি কাজ করেন বীজ রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, ফসল তোলা ও সংরক্ষণে, কিন্তু প্রযুক্তি ও বাজারে অংশগ্রহণে পিছিয়ে। জাতীয় কৃষি নীতি এবং কৃষি সম্প্রসারণ নীতিতে কৃষির সকল স্তরে নারী কৃষকের ভূমিকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া। এর ফলে তারা সরকারি প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণে সহজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। জলবায়ু-সহনশীল কৃষি প্রকল্পে অংশ গ্রহণে নারী কৃষকদের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের উৎপাদনের মূলধারায় নিয়ে আসা জরুরি।
উপকূলীয় ও খরাপ্রবণ এলাকায় কৃষি ও পানীয় জলের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ কাঠামো, কমিউনিটি ট্যাংক এবং সৌরশক্তিচালিত বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট নির্মাণে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এর তদারকির দায়িত্ব নারী দেওয়া। জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পের মাধ্যমে বিকল্প সেচ সহায়তা এবং লবণাক্ততা প্রতিরোধের জন্য নদী বা খালের সøুইগেট রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় নারী কৃষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারী কৃষকরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নন, বরং তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্ভাব্য নেত্রী ও উদ্ভাবক। কাজেই জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা তখনই সফল হবে, যখন তা জীবনের অভিজ্ঞতা ও নারীদের নেতৃত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। প্রত্যাশা কৃষিতে ‘নারী নেতৃত্বে জলবায়ু অভিযোজন’-এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় নীতি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করতে নীতি নির্ধারকহমল কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
কেকে/ আরআই