বর্তমানে দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে : আগামী জাতীয় সংসদ (ত্রয়োদশ) নির্বাচন ও অর্থাৎ গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এ সিদ্ধান্ত যে শুধুই প্রশাসনিক বা আর্থিক কারণে নয়, বরং ‘সংস্কার ও পরিবর্তনের’ প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও কার্যকর করার প্রচেষ্টা, সেটিও বুঝতে হবে।
গণভোটে ভোটারদের সামনে থাকবে একটি প্রশ্ন : আপনি কি ২০২৫ সালের সংবিধান-সংস্কার এবং এতে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলোর প্রতি সম্মতি জানাচ্ছেন? এবং ভোটারকে শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতেই হবে। এ প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন সাংবিধানিক গঠন, সংসদে উচ্চকক্ষ, নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন। এ পরিকল্পনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে।
প্রথমত এটি সময় ও অর্থের দিক থেকে কার্যকর। একসঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট করলে আলাদা আলাদা আয়োজন, বাজেট, প্রশাসনিক ব্যয় অনেক কম হবে। দ্বিতীয়ত এটি সংস্কার প্রক্রিয়াকে দ্রুত টেনে আনতে পারে; যদি ভোট তৈরি হয় জনগণের মাধ্যমে এবং গণভোট সফল হয়, তবে নতুন কাঠামো দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তৃতীয়ত রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময় ‘নতুন শুরুর’ সুযোগ হিসেবে এটি কাজ করতে পারে যদি ভোট সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়, এবং জনগণ সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে, এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে রয়েছে বড় প্রশ্ন ও ঝুঁকি।
প্রথম ন্যায্য সমালোচনা ভোটারদের জন্য তথ্যের অভাব বা বিভ্রান্তি। চারটি বা চারটিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব একসঙ্গে কিন্তু ভোট দিতে হবে মাত্র একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। এ পদ্ধতি বিশেষ করে শিক্ষাগতভাবে কম সুফলপ্রাপ্ত বা বঞ্চিত জনগণের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে, যারা হয়তো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন না তারা কিসের জন্য ভোট দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত- নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে প্রক্রিয়া জটিল ও বিশৃঙ্খল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভোট বৃদ্ধি, গোপন কক্ষ, নিরাপত্তা, ভোটার সচেতনতা সবকিছুই সাবলীলভাবে চলতে হবে। যদি প্রশাসনিক ত্রুটি হয়, তাহলে গণভোট ও নির্বাচন উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তৃতীয়ত- সংবিধানগত এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি। কিছু আইনজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দল মনে করেন, গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে করা রূপায়ণ সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি, যদি উচ্চকক্ষ গঠন হয় বা সংবিধানে বড় পরিবর্তন হয়, সেটা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারও ডেকে আনতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের সাধারণ নাগরিক, ভোটার এবং সমাজ হিসেবে দায়িত্ব আছে। প্রথমে, ভোটারদের উচিত গণভোট ও সংশোধন প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া; অর্থাৎ শুধুই ভোট দেয়া নয়, বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া। প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন, মিডিয়া-সংবাদ, নাগরিক উদ্যোগ- একত্রে কাজ করে জনগণকে তথ্য দিতে হবে। দ্বিতীয়ত নির্বাচন ও গণভোট পরিচালনায় স্বচ্ছতা এবং সুষ্ঠু পরিপ্রেক্ষিত চাওয়া। প্রশাসনকে সচেতনতা, নিরাপত্তা, তথ্য প্রবাহ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; এবং ভোটারদের দায়িত্বশীলভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
শেষে পরিবর্তনকে শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে নয়, সমাজ ও জনগণের মঙ্গল, সাংবিধানিক মূল্যবোধ তথা গণতন্ত্র জোরদার করার সুযোগ হিসেবে দেখা দরকার। যদি এই সুযোগকে শুধু শোরগোল বা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক গেমে পরিণত করা হয় তাহলে মূল লক্ষ্য হারিয়ে যেতে পারে। সুতরাং, নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত; যদি সেটি সৎ, স্বচ্ছ এবং জনমতের ভিত্তিতে হয়, তাহলে দেশ নতুন দিশা পেতে পারে। আর আমাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে অংশ নিতে হবে, শুধু ভোট দিয়ে নয় সমালোচনামূলকভাবে ভাবা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে।
কেকে/ আরআই