আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে পূর্বঘোষণা ছাড়াই নীরবে ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এক লাফে লিটারে ৯ টাকা পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। সরকারের কঠোর নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা নিয়মবহির্ভূতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে- এমনটাই মনে করছেন সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক মহলও। সরকারকে না জানিয়ে এভাবে মূল্য বাড়ানো আইনবহির্ভূত ও চরম কূটকৌশল বলে অভিযোগ ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দাবি- তাদের সম্মতি ছাড়াই ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে বাজারে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। এতে আবারও প্রশ্ন উঠেছে- নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কতটা কার্যকর ও অসহায় ব্যবসায়ীদের কাছে। বুধবার (৩ নভেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রূপচাঁদা, তীর, পুষ্টি, ফ্রেশসহ প্রায় সব ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নতুন করে যে পাঁচ লিটারের বোতল এসেছে, তা বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়; যেখানে আগের দাম ছিল ৯২০ টাকা। বোতলের গায়ে যদিও ৯২২ টাকা মূল্য মুদ্রিত, অনেক দোকানেই নতুন মূল্য অনুযায়ী ৯৬৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৮ টাকা, যা এতদিন ১৮৯ টাকায় বিক্রি হতো। তবে এক ও দুই লিটারের নতুন দামের বোতল সব দোকানে এখনও পর্যাপ্ত সরবরাহ হয়নি, ফলে বাজারে দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে গত ১০ নভেম্বর সরকারকে চিঠি দিয়েছিল উৎপাদক কোম্পানিগুলো। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য ১৯৯ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৯৮৫ টাকা নির্ধারণ করে। পাশাপাশি খোলা সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১৭৯ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ১৬৯ টাকা নির্ধারণের কথা জানানো হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, গত ১০ নভেম্বর ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছিল কোম্পানিগুলো, যা ২৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়। সমিতি প্রতি লিটার বোতলজাত তেলের দর ১৯৯ টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতল ৯৮৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৯ ও পাম অয়েল ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগাম নোটিহ ছাড়া এভাবে দাম বাড়ানো ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন। যে কোনো মূল্য পরিবর্তনের আগে তা ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক। উৎপাদকরা নিজেদের সুবিধামতো বাজারে শব্দহীনভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।’
অন্যদিকে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি ভিন্ন। তাদের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও কাঁচা পাম তেলের দাম গত এক মাসে বেড়েছে ৮-১২ শতাংশ। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় দাম সমন্বয় করা ছাড়া উপায় ছিল না। একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানান, ‘মূল্য পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি বিবেচনায় দাম সমন্বয় করা জরুরি ছিল।’
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা যে প্রক্রিয়ায় ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়েছেন এর আইনগত ভিত্তি নেই। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর আগে ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয়ের সম্মতি নেয়নি। তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে আমরা একেবারেই জানি না। কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত এই কার্যক্রম অবশ্যই গ্রহণযোগ্য না।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) ক্রয় কমিটিতে টিসিবির জন্য ৫০ লাখ লিটার সয়াবিন এবং এক কোটি লিটার রাইস ব্রান ওয়েল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। উনারা যে দামে আজকে (বুধবার) বাজারে বিক্রি করছেন, সেখান থেকে প্রায় ২০ টাকা কমে আমাদেরকেই তেল দিয়েছেন। বাজারে ২০ টাকা বেশি দামে তেল দেওয়ার আমি তো যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। গতকালই তো আমরা কিনেছি উনাদের কাছ থেকে।’
বাজারের ওপর থেকে সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ আছে কি নেই সেটা আমাদের পদক্ষেপের মাধ্যমে জানতে পারবেন। আমরা আমাদের পদক্ষেপগুলো নেব। আমাদের পদক্ষেপগুলো নেওয়ার জন্য আমাদের আলোচনার প্রয়োজন আছে। আইনসঙ্গত সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও এ সময় আশ্বাস দেন তিনি।
অতীতে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি- দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা বিজ্ঞপ্তি আকারেও দাম বাড়িয়েছিল, যেটাতে আমরা রাজি হই নাই। গত আড়াই মাস তো প্রায় পূর্বের ওই দামেই বেচাকেনা হয়েছে। যদি যৌক্তিক কোনো কারণ থাকে (দাম) বাড়ানোর, আমরা আলোচনা করতে চাই। কারণ আমরা তো সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে চাই না।’
রোজাকে ঘিরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো প্রস্তুতি আছে। যেখানে যেখানে রাজস্বের ব্যাপারে কর্মকাণ্ড করতে হবে, সরবরাহের ব্যাপারেও...। আমরা দেখেছি আমদানি পর্যায়ে যে ধরনের ঋণপত্র খোলা প্রয়োজন, যা গতবার খোলা হয়েছে, তার থেকেও অধিক আমরা দেখতে পাচ্ছি সরবরাহ ব্যবস্থায়।’
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আইন ভেঙে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা দেখার অপেক্ষায় আছি। আইন অনুযায়ী কিছু পণ্যের মূল্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেয়। মূল্য নির্ধারণ কীভাবে করা হবে সেটার একটা ফর্মুলা আছে।’
ক্যাব সভাপতি বলেন, ‘আমরা জানি মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) হঠাৎ করে ভোজ্যতেলের দাম ৯ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশন যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে তেলের দাম বাড়ায় আমি বলবো সেটা আইনের ব্যত্যয়।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া যদি তেলের দাম বাড়ানো হয়, তবে সেটি হবে ভোক্তার অধিকারের প্রশ্ন। আমি ক্যাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বলতে চাই, যে মূল্যটা বেড়ে গেছে এটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন কঠোর ব্যবস্থা নেবেন, আমরা সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি।’
রিফাইনারি বন্ধ করে দেওয়ার মতো বিধান আইনে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতা আইন আছে, ভোক্তা অধিকার আইন, যদি কেউ মজুত করে দাম বাড়ায়, সেখানে বিশেষ বিধান আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাও আছে। আমরা সেই আইনের প্রয়োগটা দেখতে চাই।’
সফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘আমাদের মিটিং থেকেই নির্দেশনা গেছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তারা আজকে থেকেই অপারেশনে নামছে, কোথায় এই ব্যত্যয়টা হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা একটু অপেক্ষা করি কি ব্যবস্থা সরকার নেয়।’
এখানে সরকারের ব্যর্থতা আছে কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো সরকার বলতে পারবে। সরকার তো এ মুহূর্তে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জে আছে। নির্বাচন এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। সেখানে আমার কাছে যেটা মনে হয় নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় হয়তোবা আরেকটু বেশি ফোকাস করা উচিত।’
ক্যাবের সভাপতি আরও বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি ইদানীং মনিটরিংটা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত অন্য যে ইস্যুগুলো আছে, রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা ইস্যুর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য কিন্তু একটি বড় ইস্যু, আমি মনে করি ভোক্তাদের স্বার্থে বাজার মনিটরিংটা আরও জোরদার করা উচিত।’
কেকে/এআর