বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকরা। তাদের বিভিন্ন অংশের একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচিতে পড়ালেখায় ছেদ পড়েছিল আগেই; এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে বার্ষিক পরীক্ষা। যে শিক্ষাকে জাতির ‘মেরুদণ্ড’ বলা হয় আজ সেই মেরুদণ্ডকেই জিম্মি করে যেন জাতি ধ্বংসের আন্দোলনে নেমেছে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল।
শিক্ষার্থীদের ঢাল বানিয়ে শুধু নিজেদের ফায়দা লুটতেই এ কাণ্ডজ্ঞানহীন আন্দোলন করছে। আসন্ন নির্বাচন ও সরকারকে প্রভাবিত করতে পেছন থেকে এতে প্ররোচনা দিচ্ছে অনেকেই; এমন দাবিও রয়েছে। এনিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইছে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও সচেতন মহলের মাঝে।
এদিকে লাগাতার কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর তিন দফা দাবি আদায়ে এবার কমপ্লিট শাটডাউনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আজ বুধবার থেকে এ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। একইসঙ্গে শিক্ষকরা উপজেলা বা থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) অফিসের সামনে অবস্থান নেবেন। অন্যদিকে সবশেষে সাত শতাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি আদায়ে গত সোমবার থেকে কর্মবিরতি শুরু করেছেন। ফলে এসব স্কুলের চলমান বার্ষিক পরীক্ষা মাঝপথে শিকেয় উঠেছে।
দাবি আদায়ের এ আন্দোলনে সরকারের তরফের হুঁশিয়ারিকেও আমলে নিচ্ছেন না তারা। কর্মবিরতির কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে করে দেশজুড়ে ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেশকিছু বিদ্যালয়ে তা হয়নি। কারণ শিক্ষকরা কর্মবিরতির অংশ হিসেবে এ পরীক্ষা বর্জন করেছেন।
কমপ্লিট শাটডাউনে প্রাথমিকের শিক্ষকরা : লাগাতার কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর তিন দফা দাবি আদায়ে এবার কমপ্লিট শাটডাউনে যাচ্ছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আজ বুধবার থেকে এ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। একই সঙ্গে শিক্ষকরা উপজেলা বা থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) অফিসের সামনে অবস্থান নেবেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, সারা দেশে আমাদের শিক্ষকরা কর্মবিরতি করছেন। দাবি আদায়ে কর্মসূচি করতে গিয়ে অনেকে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সহকারী শিক্ষক।
আন্দোলনে শিকেয় বার্ষিক পরীক্ষা : বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছেন মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষকরা। তাদের বিভিন্ন অংশের একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচিতে পড়ালেখায় ছেদ পড়ছিল মাঝে মধ্যেই; এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে বার্ষিক পরীক্ষা।
তাদের আগে থেকেই ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলনে ছিলেন। গত এক মাস ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তারা। এর আগে দশম গ্রেডে বেতনের দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা টানা আন্দোলন চালিয়ে যেতে জড়ো হয়েছিলেন ঢাকায়। পরে একাদশ গ্রেডে উন্নীত করতে সরকারের আশ্বাসে মাসখানেক পর ফিরে যান শ্রেণিকক্ষে।
এমন প্রেক্ষাপটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরীক্ষা ব্যাহত হলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
আর বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষকদের আন্দোলন উদ্বিগ্ন করছে অভিভাবকদের। তাদের পাশাপাশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গবেষকরা পেশাদারত্ব ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, শিক্ষাবর্ষের শেষাংশে এসে তাদের এ অবস্থান সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত : শিক্ষাবর্ষের শেষ প্রান্তে এবার কোনো স্কুলে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আবার কিছু স্কুলে ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে শুরুর সূচি ঠিক ছিল। বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতের পাশাপাশি সরকারিগুলোতেও সোমবার থেকে পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের স্কুলে হাজির হয়েছিলেন। তবে ৭২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চার দফা দাবিতে আগেই কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। সোমবার থেকে বর্জন করেন পরীক্ষা। ফলে স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
ননএমপিও শিক্ষকরাও টানা আন্দোলনে : স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে সোমবার ৩০তম দিনের মতো রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। ‘নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐক্য পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা সরকারি বেতন-ভাতার তালিকাভুক্তি বা এমপিওভুক্তির দাবিতে এ কর্মসূচি চালাচ্ছেন। গত ২ নভেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন ‘দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়া’ নন-এমপিও শিক্ষকরা।
ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি সরকারের : শিক্ষকদের এমন আন্দোলনের মধ্যে দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক, নির্বাচনি ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা ২০২৫ নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বা কর্মকর্তার যে কোনো ধরনের শৈথিল্য বা অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে বিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
গত সোমবার অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ১৭ ফেব্রুয়ারির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বার্ষিক পরীক্ষা ২০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বরএবং নির্বাচনি পরীক্ষা ২৭ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। একইসঙ্গে মাউশির আগের নির্দেশনা অনুযায়ী জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হবে।
আদেশে বলা হয়, পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বা কর্মকর্তার যে কোনো ধরনের শৈথিল্য বা অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে বিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিঠিটি সব জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে। এদিকে ঠিকমত বার্ষিক পরীক্ষা না নিলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও।
অভিভাবকদের উদ্বেগ : আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রেশার গ্রুপ তৈরি করে ভয়াবহ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এ আন্দোলন অভিভাবক মহলকে হতবাক করেছে। বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে চলমান বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলন করায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ফলে এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। প্রতিবাদের ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
শিক্ষকদের দুপক্ষ বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন করায় উদ্বেগ জানিয়েছে অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। ফোরামের সভাপতি জিয়াউল হক দুলু বলেন, ‘সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকরা মাঝপথে পরীক্ষা বর্জন করেছেন। এদিকে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি অংশ বার্ষিক পরীক্ষা নেননি। শিক্ষকদের এ অবস্থানে আমরা উদ্বিগ্ন।’
কেকে/এআর