গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সময় আত্মগোপনে চলে যান তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দলের বহু শীর্ষ নেতা। গণঅভ্যুত্থানে সারা দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রতি হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
রায় ঘোষণার পরই দেশজুড়ে শুরু হয় নতুন আলোচনা। ভারতে আশ্রয় নেওয়া হাসিনা ও কামালকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে কি না, যদি হয় তাহলে কীভাবে? এরপরই বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে চিঠি পাঠিয়ে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানায়। সেই চিঠির এখনো কোনো উত্তর আসেনি।
এরইমধ্যেই আরেক আলোচনার জন্ম হয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি জানান, ভারতে অবস্থানরত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসাদুজ্জামান খান কামালকে দিয়ে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু এর একদিন পরে একই বিষয়ে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘কামালকে প্রথমে প্রত্যর্পণ করা হবে- এ ধরনের কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।’
গতকাল রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি : পরিবর্তনশীল বিশ্বে একটি প্রাসঙ্গিক ভূমিকা নির্ধারণ’ শীর্ষক সেশনে তিনি এ কথা বলেন।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে অফিসিয়াল কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। আমরা সবাই জানি, উনি ভারতে আছেন। কিন্তু লিখিতভাবে সেটা আমাদের কখনো জানানো হয়নি। তাকে দিয়ে যে প্রত্যর্পণ শুরু হবেÑ এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এ মন্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বলছেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব বেড়েই চলছে। যা বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যের অসঙ্গতিতে স্পষ্ট। বিশেষ করে ভারত থেকে হাসিনা ও কামালকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এর আগে গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেনÑ‘জুলাই মাসের গণহত্যার মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে বাংলাদেশের অনুরোধ খতিয়ে দেখছে ভারত। তবে সেই প্রত্যর্পণের শুরুটা হবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজাপ্রাপ্ত আসামি আসাদুজ্জামান খান কামালকে দিয়ে।’
শফিকুল আলম লেখেন, তিনি বিশ্বাস করেন, জুলাইয়ের ঘটনাবলীর অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে একদিন বাংলাদেশের আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। ভারত এরই মধ্যে হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ পরীক্ষা করছে।
প্রেস সচিব লিখেছেন, আমরা জানি, শেখ হাসিনার ক্ষমতাবান সহানুভূতি আছে। তবুও আমি নিশ্চিত যে, ‘ঢাকার কসাই’ আসাদুজ্জামান খান কামালকে শিগগির বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ করা হবে। হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকালে সংঘটিত কথিত অপরাধের ওপর যত আলোকপাত করা হবে, গণহত্যা ও জোরপূর্বক গুমের ব্যাপারে কামালের ভূমিকা সম্ভবত বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে।
শফিকুল আলম আরও লেখেন, কামাল বা অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যত টাকা খরচ করুক না কেন, পালানো জবাবদিহি চিরকাল থাকবে না। জাতি হিসেবে যদি আমরা জুলাই মাসের গণহত্যার শিকারদের জন্য এবং হাসিনা আমলে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তাদের জন্য ন্যায়বিচারের ওপর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও মনোযোগ নিবদ্ধ করি, তাহলে এর পরিণতি এড়িয়ে যাওয়া দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠবে। কামাল দিয়ে শুরু হবে তারপর...।
উল্লেখ্য, গত ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেন, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। একইসঙ্গে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উন্মোচন করেছেন, মামুনের অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ হলেও সত্য উন্মোচন করায় তার সাজা কম হবে।
এর আগে এদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রায় ঘোষণা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ৪৫৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়েন আদালত।
এ ছাড়া গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) এবং ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। গত ১২ মে প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে।
এর ভিত্তিতে ১ জুন ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ওই দিনই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেন। এরপর ১০ জুলাই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এ মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রুভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের করা আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তী সময়ে এ মামলার রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন তিনি।
কেকে/এমএ