সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা। জন্মদাত্রী মা বেগম খালেদা জিয়া সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন। উৎকণ্ঠায় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সারা দেশ। তেমন কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছেন না চিকিৎসকরাও। দেশনেত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে নেওয়ার প্রচেষ্টাও সফল হচ্ছে না-তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। তবুও কেন ফিরছেন না তারেক? -এ প্রশ্নটিই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এ আলোচনা। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তারেক রহমান জানিয়েছেন, দেশে ফেরার বিষয়টি তার একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। এরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, সরকারের পক্ষ থেকে তার (তারেক রহমান) দেশে ফেরার কোনো বাধা নেই। গতকাল রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও জানিয়েছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার ইচ্ছা থাকলে বাংলাদেশ হাইকমিশন এক দিনের মধ্যেই ট্রাভেল পাস দিতে সক্ষম। এখন প্রশ্ন উঠছে-তারেক রহমান দেশে ফিরতে চাইলেও আসল বাধা কোথায়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন-তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি যতটা সহজভাবে পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, বাস্তবে বিষয়টি অনেক বেশি জটিল। তাদের মতে, যুক্তরাজ্যে অ্যাসাইলাম; হিউম্যানিটারিয়ান প্রোটেকশন কিংবা আইএলআরের মতো স্ট্যাটাস পাওয়া যেমন একদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে স্বদেশে ফেরার পথ কঠিন করে তোলে। এক্সাইল স্ট্যাটাসের মূল ভিত্তি হলো- নিজ দেশে ফিরে গেলে তার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ দেশে ফিরতে চাইলে যুক্তরাজ্যকে আবারও মূল্যায়ন করতে হয় বাংলাদেশে তার নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হবে। এখানেই তৈরি হয় বড় ধরনের আইনি ও কূটনৈতিক দ্বৈততা। সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয় পাসপোর্ট ইস্যুতে। এক্সাইলের জন্য সাধারণত নিজ দেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হয়, ফলে পুরোনো পাসপোর্ট দিয়ে আর ভ্রমণ করা যায় না এবং নতুন পাসপোর্ট বা ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেতে হলে ঢাকা থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সবুজ সংকেত আসার অপেক্ষা করতে হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব প্রশাসনিক জটিলতার বাইরেও সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ‘নিরাপত্তা’। দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বহু হত্যাকাণ্ড ও আকস্মিক হামলার অভিজ্ঞতা মাথায় রাখলে এ ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। ফলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে গুপ্ত হত্যার শঙ্কাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেশের বিভিন্ন সেক্টরে তার প্রেতাত্মারা এখনো বসে আছেন। সেইসঙ্গে ওতপেতে রয়েছে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাও। মরণকামড় দিতে মুখিয়ে আছে প্রতিহিংসাপরায়ণ নেত্রী শেখ হাসিনা, টার্গেট তারেক রহমান। এই তারেক রহমানকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাতে পারলেই আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পোয়াবারো। ফলে সঙ্গত কারণেই বর্তমানে বাংলাদেশে তারেক রহমানের নিরাপত্তা শঙ্কা রয়েছে।
তারেক রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছিল- তিনি (তারেক রহমান) দেশে ফিরছেন কি না। দলের নেতারা বিশেষ সময় বেঁধে দিয়ে বলছিলেন তিনি ফিরবেন; কিন্তু তারেক রহমান ফিরছিলেন না। আজ প্রথমবারের মতো তিনি পরিষ্কার করলেন- কেন তিনি আসছেন না। তার বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে ফেরা তার নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। এমন কিছু বিষয় আছে, যা অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ ছাড়া তিনি সব কিছু প্রকাশ করতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেছেন এবং শেষ লাইনটিতে বলেছেন-রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রত্যাশিত পর্যায়ে উপনীত হলে তিনি দেশে ফিরবেন।’ শনিবার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন প্রশ্নরাজনৈতিক পরিস্থিতি কী? আমার কাছে মনে হয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আসলে বিএনপিও তারেক রহমানের অনুকূলে নেই। আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। আমি ফেব্রুয়ারিতে এখন আর নির্বাচন দেখি না। আবারও বলছি- এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়তো হতে পারে তিন মাস পর, ছয় মাস পর, কিংবা ফেব্রুয়ারির আগেও হতে পারে। সময় নেই- কথার কথা বলছি। কিন্তু এদের অধীনে প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তারা নানা চক্র ও ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি সেই টোপে পা দিয়েছে।’
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ‘গত কিছুদিন আমরা দেখলাম- জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি সবাই হইচই করছে কে কার সঙ্গে জোট করছে ইত্যাদি। আবার গত কয়েক দিন সব কিছু থমথমে, উত্তেজনাপূর্ণ, বিপজ্জনক। এ থমথমে ভাবটাও ভীষণ ভীতিকর। এর মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টা কখনো দোহায়, কখনো যুক্তরাষ্ট্রে, কখনো দিল্লিতে ছোটাছুটি করছেন।’
তিনি মনে করেন, ‘আগামী কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্যই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল হতে পারে। এবং সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে- আমরা কেউই জানি না। এখানে যদি একটি জনগণের সরকার থাকত, নির্বাচিত সরকার থাকত, সঠিক রাজনীতি থাকত পরিস্থিতিটা অন্য রকম হতে পারত। তারপরও আমরা প্রত্যাশা করি- ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়েও মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, দেশ ঘুরে দাঁড়ায়। খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও ইতিবাচক ধারা তৈরি হতে পারে। সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
কেকে/এআর