ইসরায়েলের চলমান হামলায় পরিবার-পরিজন হারানো এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে গাজার শত-শত শিশু এখন স্কুলের ক্লাসরুম নয়, রাস্তায় নেমে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আট বছর বয়সী ছোট শিশুরাও নেমে পড়েছে জীবিকার তাগিদে। যুদ্ধের কারণে অন্তত ৩৯ হাজার শিশু এক বা উভয় অভিভাবক হারিয়েছে। কর্মসংস্থান ধসে পড়ায় অনেক পরিবার সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে শিশুদের রোজগারের ওপর। প্রায় বাধ্য হয়েই ছোট সদস্যদের কাজে পাঠাতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে।
গাজায় কাজ করা মানবিক সংস্থাগুলো বলছে- শিশুরা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত। তারা আবর্জনার স্তূপে উচ্ছিষ্ট খোঁজা, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, কফি বিক্রি- এসব কাজে ক্রমশ জড়াচ্ছে। ইউনিসেফ জানায়, পরিবারগুলোকে নগদ সহায়তা ও সচেতনতা দিয়ে শিশু শ্রম কমানোর চেষ্টা চলছে।
পশ্চিম তীরের রামাল্লায় পরিচালিত সেভ দ্য চিলড্রেনের মানবিক কার্যক্রম পরিচালক র্যাচেল কামিংস বলেন, যুদ্ধে পরিবারিক কাঠামোর ধ্বংস ও শিশুদের বড় ভাই-বোন বা অন্যান্য বড় পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়ার ভূমিকা নিতে বাধ্য করছে। তিনি যোগ করেছেন, ‘গাজায় পুরো পরিবারিক কাঠামোই বিপর্যস্ত এবং শিশুরা অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি তাদের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করছে’। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসেবে প্রায় ছয় লাখেরও বেশি শিশু এখন স্কুলের বাইরে, এবং প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে।
ক্ষুধার কষ্ট বাড়ছে, তীব্র অপুষ্টিতে ৪ লাখ শিশু : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় প্রায় ৪ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টির শিকার এসব শিশুর চিকিৎসা করতে অন্তত ১০টি হাসপাতাল দরকার। গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া ও নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু হাসপাতালের পরিচালক আহমদ আল-ফারা এ কথাগুলো বলেছেন।
আবু সালমিয়া বলেন, শিশুদের পাশাপাশি গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে আহত হয়ে আরও যারা ভর্তি হয়েছেন, তারাও বিভিন্ন মাত্রায় অপুষ্টিতে ভুগছেন। অপুষ্টি গাজার অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
সম্প্রতি দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজা উপত্যকার গাজা নগর প্রশাসনিক অঞ্চল ও আশপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছে। এতে অন্তত ৫ লাখ ১৪ হাজার গাজাবাসী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী মাসের শেষের দিকে উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের প্রশাসনিক অঞ্চল দেইর আল-বালাহ ও দক্ষিণের খান ইউনিসেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের অনুদান ও সহায়তায় পরিচালিত আইপিসির প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল গাজায় দুর্ভিক্ষের দাবি অস্বীকার করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আইপিসির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এক বিবৃতিতে গাজার দুর্ভিক্ষকে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ ও ‘মানবতার ব্যর্থতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ‘গাজার দুর্ভিক্ষকে ইসরায়েল সরকারের কর্মকাণ্ডের সরাসরি ফলাফল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, গাজায় নিজেরা যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, তা অস্বীকার করা ইসরায়েলকে বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, যাদের (যেসব দেশের) প্রভাব আছে, তাদের এটাকে (আইপিসির প্রতিবেদনকে) গুরুত্ব ও নৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিব টম ফ্লেচারের বিবৃতি ধরে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান।
আইপিসির প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় টম ফ্লেচার বলেন, ‘এ দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি ঠেকানো যেত। কিন্তু ইসরায়েলের পরিকল্পিত বাধায় গাজায় খাদ্য ঢুকতে পারছে না। তাই দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে।’ মিসর সীমান্তে ত্রাণভর্তি হাজারো ট্রাক কয়েক মাস ধরে গাজায় ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু গত মার্চ থেকে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে সেগুলো গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। মে মাসের শেষ থেকে তারা গাজায় কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ৬৭ শিশু নিহত : টানা দুই বছরের ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর গত মাসে গাজায় কার্যকর হয়েছে যুদ্ধবিরতি। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এরপর থেকে গাজায় অন্তত ৬৭ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
নবজাতক শিশুসহ বিপুলসংখ্যক এসব মৃত্যু ইসরায়েলি হামলার ফলেই ঘটেছে। আর এটি নিয়েই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পিরেস জানান, নিহতদের মধ্যে একটি নবজাতক মেয়েশিশুও রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হত্যা করা হয়। এর আগের দিনও ইসরায়েলের একাধিক হামলায় আরও সাত শিশু নিহত হয়।
পিরেস বলেন, ‘এগুলো সবই ঘটছে ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মধ্যে। চলমান এই ঘটনাপ্রবাহ ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক।’ তিনি আরও বলেন, এগুলো কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি শিশু ছিল একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি জীবন নিয়ে, যা অব্যাহত সহিংসতায় মুহূর্তেই নিভে গেছে।’
ইউনিসেফের হিসেবে, গাজায় ইসরায়েলি হামলার সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪ হাজার শিশুর মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে চ্যারিটি সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, ২০২৪ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৪৭৫ জন ফিলিস্তিনি শিশু আজীবনের মতো পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এসব শিশুদের অনেকের মস্তিষ্কে আঘাত, আবার কারও সারা শরীরে দগ্ধ ক্ষত রয়েছে। সংগঠনটি বলছে, আধুনিক ইতিহাসে গাজাই এখন সবচেয়ে বেশি শিশুর অঙ্গচ্ছেদের এলাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিসেফ মুখপাত্র পিরেস বলেন, বহু শিশু খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে এবং বন্যায় প্লাবিত অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তার ভাষায়, ‘গাজার শিশুদের জন্য বাস্তবতা একটাই, আর তা হচ্ছে- তাদের জন্য কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই। তাদের এই যন্ত্রণাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া মানবিকতার পরিপন্থি।’ তিনি আরও বলেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টানা শীতে তাঁবুতে থাকা লক্ষাধিক শিশুর জন্য শীতকাল আরও বড় হুমকি হয়ে সামনে এসেছে।
সংঘাতের সমাধান ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র : ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপ লিও চতুর্দশ বলেছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাতের একমাত্র সমাধান হল একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। রবিবার তুরস্ক থেকে লেবাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেছেন।
পোপ বলেছেন, “আমরা সবাই জানি, এই সময়ে ইসরায়েল এখনো সেই সমাধান গ্রহণ করে না, তবে আমরা এটিকে একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখি। আমরা ইসরায়েলেরও বন্ধু এবং আমরা দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কণ্ঠস্বর হতে চাইছি যা তাদের সবার জন্য ন্যায়বিচারের সমাধানে সহায়তা করতে পারে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বারবার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। তিনি সাফ জানিয়েছেন, কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। লিও তার তুরস্ক সফরের উপর আলোকপাত করে আট মিনিটের একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
পোপ জানিয়েছেন, তিনি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেব এরদোগান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেন-রাশিয়া উভয় সংঘাত নিয়েই আলোচনা করেছেন। উভয় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পোপ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিশ্বের অস্বাভাবিক সংখ্যক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে মানবতার ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি ধর্মের নামে সহিংসতার নিন্দা করেছেন।
কেকে/এআর