দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরাসহ নানা ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে বিরাজ করছে টালমাটাল অবস্থা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।তারা বলছেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা বিদ্যমান। ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের ওপর গভীর নজরদারি রয়েছে বিশ্বের একাধিক পরাশক্তির। সঙ্গত কারণেই এ দেশের সার্বিক বিষয়ে তাদের একটা অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে। ফলে তাদের মতামতকে একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত এই পরাশক্তিদের মধ্যে অন্যতম। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পরাশক্তিরা কখনই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা দেখতে চায় না। তারা সব সময় এ দেশে তাদের আজ্ঞাবহ পুতুল সরকার বসাতে চায়। আর যে রাজনৈতিক দল বিপক্ষে অবস্থান নেয় তাদের ফাঁদে ফেলানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাকড়সার জালের মতো বিছানো রয়েছে এসব দেশের গোয়েন্দা জাল। তারা চাইলে অনেক কিছুই ঘটাতে পারে। তাই তাদের মতামতের বাইরে যাওয়া খুব একটা সহজ নয়।’ তিনি বলেন, ‘ভারত এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এটা অবলীলায় বলা যায়- এখন নির্বাচন হলে বিএনপি সরকার গঠন করবে। কিন্তু প্রতিবেশীদের আপত্তির জায়গা সেখানেই। কারণ বিএনপি তাদের আগের শাসনামলে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করেনি। অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে সর্বস্ব দিয়েছে। ফলে হাসিনাই তাদের গুডবুকে, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নয়। যে কারণে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন বানচালের জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে এই দেশটি।’
এদিকে বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে না ফিরতে পারার ইস্যুতে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে দেশের রাজনীতিতে। অনেকটা মনোবল হারিয়েছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাদের শঙ্কা- বেগম জিয়ার কিছু হয়ে গেলে এবং তারেক রহমান দেশে ফিরতে না পারলে অনেকটা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে বিএনপি। এবং এই সুযোগটিরই অপেক্ষা করছেন ষড়যন্ত্রকারীরা। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা তৃতীয় কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা করছে।
যদিও সরকার ঘোষিত সময় অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কোনো কমতি রাখছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতোমধ্যেই ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। এবার ভোটের দিনক্ষণ নির্ধারণের পালা। ইতোমধ্যেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার কথা জানিয়েছেন।
তবে ইসি সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আসন্ন নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে হলেও তফসিল নিয়ে চিন্তিত কমিশনের ঊর্ধ্বতনরা। পুরো নির্বাচনি কার্যক্রম কবে কখন কোন দিনে বাস্তবায়ন করা হবে সেসব নিয়ে নিয়মিতই বৈঠক করছেন। সেজন্য নির্বাচনের তফসিল কত তারিখে হবে এ নিয়ে জোর আলোচনাও চলছে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মধ্যে। সূত্রটি আরও জানায়, তফসিলের জন্য দুটি দিন আলোচনায় রয়েছে। একটি হলো- ৮ ডিসেম্বর এবং অন্যটি হলো ১১ ডিসেম্বর। এই দুইদিনের যেকোনো দিনেই তফসিল ঘোষণা করতে পারে ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আব্দুর রহমানেল মাছউদ গণমাধ্যমকে বলেন, তফসিলের দিন তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের আলোচনা চলছে। তবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করা হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান সরকারের অধীনে আমি কোনো নির্বাচন দেখি না। আমি আবারও আমার কথার পুনরাবৃত্তি করছি- যদি কোনো নির্বাচন হয়ও, সেটা হবে একটি ‘ফার্সিকাল ইলেকশন’। সেটা ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪-এর মতো হতে পারে; এমনকি আরও পেছনে তাকালে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালের মতোও হতে পারে। বাস্তবে আমি এখন আর কোনো নির্বাচনই দেখি না।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে গত শনিবার প্রকাশিত বিশ্লেষণে তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই হয়তো অবাক হন- আমি কেন নির্বাচন দেখি না? কিন্তু আমার পাল্টা প্রশ্ন হলো- আপনারা কেন নির্বাচন দেখেন? কোন যুক্তিতে দেখেন? নির্বাচনের কী প্রস্তুতি আছে? সরকারের কোন সদিচ্ছা দেখা যায়? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক কী ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করেন?
জিল্লুর রহমান আরও মনে করেন, নির্বাচন বহু আগেই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘গত ১৪ মাসে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি যেভাবে সংকটে পড়েছেÑ তার ভিত্তিতে নির্বাচন আরও আগেই হয়ে যেতে পারত। আমি শুরু থেকেই বলেছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। বিএনপিও নির্বাচনের জন্য সরকারকে তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।’
এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হওয়া শঙ্কা দূর করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ২৪ নভেম্বর ময়মনসিংহ নগরীর ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত প্রাক-নির্বাচনি আঞ্চলিক পরামর্শ সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নিরাপত্তার অভাব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। এই শঙ্কা দূর করে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কেকে/এআর