বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফুসফুসের সংক্রমণজনিত শ্বাসকষ্টে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এর ওপর দীর্ঘদিনের কিডনি, লিভার, আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসের জটিলতাও যোগ হওয়ায় তার চিকিৎসা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে- একটি সমস্যার চিকিৎসা করতে গেলে আরেকটি জটিলতা বাড়ছে।
এ অবস্থাকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘অত্যন্ত সংকটময়’ বলে বর্ণনা করেছেন। দলটির নেতাদের দাবি, গত দুই দিনে তার শারীরিক অবস্থায় কোনো অগ্রগতি নেই। চিকিৎসকরা সম্ভব হলে দ্রুত তাকে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন।
দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে খালেদা জিয়াকে হারালে আমরা হারাব বাংলাদেশের সব থেকে দরদি ও দায়িত্বশীল অভিভাবককে। স্বয়ং বিএনপির পরিচয়ও তার উপস্থিতি ছাড়া অসম্পূর্ণ মনে হয়। তিনি বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে যে পরিমাণ চাপ সহ্য করেছেন, তা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সামান্য অংশ নেওয়াও কঠিন। লন্ডনে নিরাপদে থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি জানতেন যে দেশে ফিরলে কারাবাস ও মৃত্যুঝুঁকি দুই-ই রয়েছে-তবুও ২০০৮ সালে তিনি দেশেই ফিরে এসেছিলেন। দেশের প্রতি তার মমত্ববোধই তাকে ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল।
কীভাবে বেগম জিয়া দলের ক্রান্তিকালে, দেশের ক্রান্তি কালে দায়িত্বশিল ভূমিকা পালন করেছেন তার তার কার্যাবলি দেখলেই বুঝতে পারব।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ ঘটে। কয়েক দিন পর, ৮ জানুয়ারি দেওয়া এক সংবাদপত্র বিবৃতিতে তিনি জানান যে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র গড়ার উদ্দেশ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে দলটির কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছেন যে বিএনপির ঐক্য ও সংহতি হুমকির মুখে, সেই কারণেই নেতাদের তার ওপর নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছেন। দলের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। তার লক্ষ্য ছিল দেশ ও জাতির স্বার্থ এবং শহীদ জিয়ার গড়া দলের ঐক্য বজায় রেখে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ সামরিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে খালেদা জিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। রাজপথে নেতৃত্ব দিতে দিতে ১৯৮৪ সালের আগস্টে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর নানা হুমকি ও ষড়যন্ত্র তাকে ঘিরে থাকলেও তিনি নির্ভীক, দৃঢ়চিত্ত ও আপসহীনভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যান।
১৯৮৬ সালের প্রহসনের নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একসঙ্গে নির্বাচন না করার অঙ্গীকার করেছিলেন। খালেদা জিয়া সে সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত এরশাদের সঙ্গে সমঝোতায় নির্বাচনে অংশ নেন। এতে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ‘জাতীয় বেইমান’ বলা হয়। খালেদা জিয়া তখন আরও পাঁচ বছর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একক নেতৃত্ব দেন এবং গণমানুষকে সংগঠিত করেন। কঠোর দমন-পীড়নের মধ্যেও তিনি আন্দোলনকে শক্তিশালী রাখেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত একদফা আন্দোলনে দেশের মানুষ রাজপথে নেমে আসে এবং অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণআন্দোলন সফল হয় এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তার দৃঢ় নেতৃত্বের ফলে তিনি দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃচালু করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে দেশের স্বার্থ রক্ষায় ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করেন এবং সংসদ ও রাজপথ- উভয় ক্ষেত্রেই শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয় অর্জন করে। এর পরের চিত্রতো সবারই কমবেশি জানা।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার ঘটনার পর দেশে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়, যার জের ধরে সামরিক সমর্থিত ১/১১ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয় এবং এসব নির্যাতনকে বৈধতা দিতে শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতির অজুহাত তুলে ধরে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে দুর্বল করে বাংলাদেশকে নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ গভীর রাতে কোনো মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই সেনানিবাসের বাসা থেকে তারেক রহমানকে তুলে নেওয়া হয় এবং পরদিন কোর্টে হাজির করা হয়। কয়েক মাস পর গ্রেপ্তার করা হয় বেগম খালেদা জিয়াকেও। দুজনকেই কেন্দ্রীয় কারাগারে কঠোর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়, আর সেই নির্যাতনের ফলে তারেক রহমান স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। স্বাধীনতার ঘোষকের সন্তানকে এভাবে নিপীড়নের ঘটনা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাতীত।
২০০৮ সাল থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া আইনি অবরোধের সম্মুখীন হন। তার বিরুদ্ধে ৩৭টির ও বেশি মামলা করা হয়েছিল। এ মামলাগুলোর ব্যাপকতা এবং ধরন ইঙ্গিত করে যে আইনি কৌশলটি শুধু তাকে অভিযুক্ত করার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি এবং গুরুতর নাশকতার অভিযোগ যেমন- হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মামলা।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নাশকতার মামলাগুলোর বেশির ভাগই (যেমন- রাজধানীর দারুসসালাম থানায় ১১টি এবং যাত্রাবাড়ী থানায় ৪টি মামলা)। যেই মামলাগুলো এখনো পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়নি।
তবে আওয়ামী শাসনামলে বেগম জিয়ার কারাজীবনের মূলে ছিল দুটি মামল-
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা :
এ মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দায়ের করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত তাকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। খালেদা জিয়ার আপিলের পর হাইকোর্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজার পরিমাণ বৃদ্ধি করে ১০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে ২। এ বর্ধিত সাজা তার নির্বাচনি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ কার্যত চিরতরে বন্ধ করে দেয়।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা :
২০১০ সালের ৮ আগস্ট অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে দুদক মামলাটি দায়ের করে। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রায়ে খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয় । এ দুটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার ফলেই তিনি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারাবন্দি হন।
এই দুটি মামলা যে রাজনৈতিক হয়রানির জন্য এটি দেশের মানুষের কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না। এটি স্পষ্ট হয় নাইকো দুর্নীতি মামলার দিকে তাকালে ওই মামলায় যারা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের কেউ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য দেননি। ফলস্বরূপ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ সব আসামিকে খালাস প্রদান করেন। রায় ঘোষণার সময় বিচারক মৌখিকভাবে মন্তব্য করেন যে, মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়াকে হয়রানি করার জন্য করা হয়েছিল।
এ ঘটনা সরকারের আইনি প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে তীব্র প্রশ্ন তুললেও, এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জটিলতা ফুটিয়ে তোলে। একদিকে, নাইকো মামলায় রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, কিন্তু একই সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, যা তাকে সাংবিধানিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আইনি বিশ্লেষণে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার ওপর ৩৭টি মামলার আইনি অবরোধ তৈরি করার মূল লক্ষ্য ছিল সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা।
দুর্নীতির অভিযোগ আইনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বেগম জিয়াকে নির্বাসিত করা। এটি ছিল হাসিনা সরকারের একটি অপকৌশল। এ কৌশলের মাধ্যমে হাসিনা সরকার নিশ্চিত করে যে আন্দোলনের শক্তি যাই হোক না কেন, সাংবিধানিক পথে বেগম জিয়ার প্রত্যাবর্তন রুদ্ধ থাকবে।
এ মুহূর্তে কলামটি যখন লিখছি পুরো দেশ তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই তার সার্বিক সুস্থতা কামনা করছেন। কারণ, দেশের মানুষ ও দেশকে এ ক্রান্তিকাল থেকে মুক্তি দিতে তার বেঁচে থাকা যে কতটা জরুরি তা দেশের মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছে। আপসহীন এ নেত্রীর সার্বিক সুস্থতা কামনায় শেষ করছি।
কেকে/এমএ