দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জলবায়ু আলোচনা মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিশ্রুতিকেই কেন্দ্র করে থেকেছে। কিন্তু আসল এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রশ্ন- জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন কত দ্রুত এবং কীভাবে বন্ধ হবে- রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তা সবসময় এড়ানো হয়েছে। কপ২৮-এ প্রথমবার ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও তা ছিল ধীর এবং অসম। এ প্রেক্ষাপটে লুলা দা সিলভার স্পষ্ট অবস্থান স্থবিরতা কাটানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা।
তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘পৃথিবী আর নিবিড়ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সহ্য করতে পারে না,’ এবং এর পর্যায়ক্রমিক অবসানের জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি তুলেছেন। বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ঐতিহাসিকভাবে বড় উৎপাদক দেশ ও জ্বালানি কোম্পানিগুলোই এই রূপান্তরের প্রধান বাধা হিসেবে পরিচিত।
তবে প্রতিরোধের উৎস শুধু মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান নয়; অনেক সরকারও সামাজিক ন্যায়বিচার ও দরকারি পরিষেবার অর্থায়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ায় দ্রুত পর্যায়ক্রমিক বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত। ব্রাজিল এ দোলাচলের স্পষ্ট উদাহরণ- একদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিপুল সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে গভীর দারিদ্র্য ও শক্তিশালী অফশোর তেল খাতসহ একটি জটিল অর্থনীতি। লুলার ‘পরিকল্পিত ও ন্যায্য’ জীবাশ্ম জ্বালানি অবসানের আহ্বান তাই বোঝায় যে সুশৃঙ্খল রূপান্তর উন্নয়নকে দুর্বল না করে বরং শক্তিশালী করতে পারে। এখন ব্রাজিলের সামনে চ্যালেঞ্জ- নিজস্ব শক্তি রূপান্তর পরিচালনা করা এবং একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এই দ্বৈত ভারসাম্যের প্রতিফলন দেখা যায় লুলার প্রস্তাবিত জাতীয় তহবিলে, যেখানে তেলের রাজস্বের একটি অংশ সবুজ রূপান্তরে বিনিয়োগ করা হবে। এটি এমন এক কৌশল, যেখানে পুরোনো অর্থনীতির আয়কে নতুন অর্থনীতির ভিত্তি গঠনে ব্যবহার করা হবে- এবং তা শ্রমিক বা দুর্বল জনগোষ্ঠীর ক্ষতি না করেই। বিশ্বে এমন উদাহরণ আগেও দেখা গেছে। নরওয়ের সার্বভৌম তহবিল তেলের রাজস্বকে দীর্ঘদিন ধরে কম-কার্বন খাতে বিনিয়োগে ব্যবহার করছে এবং আমাজন ফান্ডকেও সহায়তা দিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পূর্ব তিমুরও পেট্রোলিয়ামভিত্তিক আয় ব্যবহার করে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য গড়ে তুলছে।
জলবায়ু আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করেছিলেন যে তেলের অর্থ নিয়ে আলোচনা করলে নিষ্কাশন কার্যক্রম বৈধতা পাবে, কিন্তু এ এড়িয়ে চলা সম্পদনির্ভর দেশগুলোকে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত করেছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন পর্যাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি রাজস্বকে সুপরিচালিত তহবিলের মাধ্যমে সবুজ রূপান্তরে ব্যবহার করাই যৌক্তিক পথ।
মাত্র দশ বছর আগেও জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত ভবিষ্যৎ কল্পনা করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক বাস্তবতা বদলে গেছে- নবায়নযোগ্য জ্বালানি আরও সাশ্রয়ী এবং পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি পরিপক্ব হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো শক্তি রূপান্তরকে উৎপাদনশীলতা, স্থিতিস্থাপকতা, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখছে। ব্রাজিলের অভিজ্ঞতাও এই প্রবণতাকে সমর্থন করে। দেশটি দীর্ঘদিন তেলের ভাড়ার ওপর সামাজিক কর্মসূচি ও অবকাঠামোর জন্য নির্ভর করলেও এখন তা জৈব জ্বালানি, টেকসই বিমান জ্বালানি এবং বৃহত্তর নবায়নযোগ্য ব্যবহারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইতিহাসে নিষ্কাশন শিল্পনির্ভর এলাকাগুলোতেও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, যা দেখায় যে রূপান্তর উন্নয়ন এজেন্ডাকে বাধাগ্রস্ত না করে বরং আরও দৃঢ় করতে পারে।
তবে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ার ঝুঁকি ব্রাজিলের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি গভীর জলের ড্রিলিংয়ে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কপ৩০-এর কয়েক সপ্তাহ আগে পেট্রোব্রাসকে আমাজন নদীর মোহনায় ড্রিলিং লাইসেন্স দেওয়া হয়- যেটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল। জ্বালানি নিরাপত্তার যুক্তিতে কিছু কর্মকর্তা এটি সমর্থন করলেও পরিবেশবাদীরা বলছেন, এটি ব্রাজিলের জলবায়ু নেতৃত্বকে দুর্বল করে। এ ধরনের উত্তেজনা এড়ানো যেত একটি স্পষ্ট ও সুগঠিত রূপান্তর পরিকল্পনার মাধ্যমে, যা অ্যাড-হক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে না।
কপ৩০-এ নেতৃত্ব শক্তিশালী করতে চাইলে ব্রাজিলের নতুন ট্রানজিশন ফান্ডকে প্রতীকী রাখলে চলবে না; রাজস্ব বণ্টনকে স্বচ্ছ করতে হবে, শাসন কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে এবং নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিকল্পনাটিকে দেশের পরিবেশগত রূপান্তর কৌশলের সঙ্গে যুক্ত করলে নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ শিল্প, টেকসই অবকাঠামো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে বিনিয়োগ আরও কার্যকর হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রাজিলের কপ৩০ সভাপতিত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার জন্য একটি সহযোগী কাঠামো তৈরি করা।
কোস্টারিকা ও ডেনমার্কের উদ্যোগে গঠিত ‘বিয়ন্ড অয়েল অ্যান্ড গ্যাস অ্যালায়েন্স’ সরবরাহ পক্ষের পদক্ষেপ উৎসাহিত করলেও বড় উৎপাদকরা এতে যোগ দেয়নি। ব্রাজিল এই দূরত্ব কমাতে পারে- উৎপাদক দেশগুলোকে একটি নমনীয় ও সুশৃঙ্খল নির্দেশিকা তৈরিতে উৎসাহিত করে। আলোচনায় এমন মানদণ্ড তৈরি হওয়া প্রয়োজন, যা প্রতিটি দেশের সক্ষমতা ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব অনুযায়ী বাস্তবসম্মত সময়সীমা নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি নতুন আমলাতন্ত্র তৈরি না করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে কার্যকর প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করাকে জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা। এতে প্রমাণ হবে যে বহুপাক্ষিকতা এখনো কার্যকর, দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়েও সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম, জীবাশ্ম জ্বালানিকে আর ‘অস্পৃশ্য’ মনে করা হচ্ছে না এবং উৎপাদক দেশগুলোও সহযোগী কাঠামোর অংশ হতে আগ্রহী।
শেষ পর্যন্ত সবুজ রূপান্তরের সফলতা নির্ভর করে জীবাশ্ম জ্বালানি রাজস্বের প্রশ্নটি সরাসরি মোকাবিলা করার ওপর। তা না হলে জলবায়ু উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারবে না। ব্রাজিল কপ৩০-এ এই বিতর্ক উত্থাপন করে এবং রূপান্তরকে পরিবেশগত জরুরি অবস্থা নয়, বরং একটি আর্থ-সামাজিক সুযোগ হিসেবে উপস্থাপন করে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো এ নতুন আলোচনা যেন দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি সুসংহত, বাস্তবসম্মত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় রূপ পায়।
লেখক : সাংবাদিক
কেকে/এমএ