বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে না ফিরলে আইনি ব্যবস্থা      রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসিকে তফসিল দেওয়ার আহ্বান নাহিদের      খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা      অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে : উপদেষ্টা ফরিদা      প্রবাসীরা ৬০ দিনের বেশি দেশে থাকলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে      এভারকেয়ারের পাশে সেনা-বিমান বাহিনীর মহড়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ      শীত নিয়ে দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
এক নেত্রীর অসুস্থতা, পুরো জাতির পরীক্ষা
মো. আজমির হোসেন
প্রকাশ: শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫, ৬:০৪ পিএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বহু অনিশ্চয়তা, অনেক সংঘাত, রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং সফল নেতৃত্বের শিল্পে রঞ্জিত। এই ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে একটি নাম অমোচনীয় ইমপ্রেশন এঁকে যাবে যুগ যুগ ধরে। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

তিনি শুধুই একজন রাজনৈতিক নেতা নন; বরং তিনি এমন এক আপোষহীনতার উজ্জ্বল প্রতীক, যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না কেবল বিএনপির দলীয় পরিচয়ে। বাংলাদেশের সাবেক তিন বারের সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন সফল প্রশাসনিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার প্রতিটি সুদৃঢ় পদক্ষেপে তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়াকে বোঝার জন্য জানতে হয় উপমহাদেশের ইতিহাস, নারীর রাজনৈতিক উত্তরণের পথ, ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অমোঘ নির্মমতাকে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বহু পরিবার যেখানে রাজনীতি থেকে এবং রাজনৈতিক জটিল পথ থেকে সরে যায়, সেখানে খালেদা জিয়া পরিণত হন জনতার নেত্রী হিসেবে দেশের আপামর সাধারণ জনগণের এক বিরাট অংশের আশ্রয়স্থল আশা-ভরসা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে। যেন স্বামী হারানোর শোকই তাকে রাজনৈতিক যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে, আর প্রতিপক্ষের প্রতিটি আঘাত তাকে করেছে আরও দৃঢ়। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু নারী নেতা এসেছেন যেমন: ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দনায়েকে। কিন্তু খালেদা জিয়ার যাত্রা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রাজপথের আন্দোলন লড়াই সংগ্রামের গল্প। যেখানে নারীত্বের কোমলতার পাশে লুকিয়ে ছিলো এক লৌহদৃঢ়তার শক্তিশালী মনোভাব এবং আপোষহীনতার অমোঘ দ্যুতি।

তার জীবনের রাজনৈতিক সংগ্রামকে তুলনা করা যায় নদীর স্রোতধারার সঙ্গে যা কখনো থেমে থাকেনি। সকল বাধাকে ভেঙে নতুন পথ তৈরি করেছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতির অগণিত বাঁক, ষড়যন্ত্রের আস্তরণ, অপপ্রচারের কোলাহল এবং দেড় যুগব্যাপী জেল-জুলুম, মামলা, দমননীতি—এসবই ছিল তার পথের পাথেয়। তবুও তিনি রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগের দেয়া প্রতিটি অন্যায় আঘাতের সামনে দাঁড়িয়েছেন নীরবে সাহসিকতার সাথে এবং অবিচল ভুমিকা নিয়ে। নীরবতা কখনো কখনো অনেক বেশি তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ হয় যার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিএনপি। বিরোধী দল হিসেবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নানা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং দীর্ঘসময় তার দল বিএনপি সরকারে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিরোধী দল হিসেবে তীব্র আন্দোলন দমনে তার নীরব অবস্থানই বহু সময় প্রতিপক্ষকে উদ্বিগ্ন করেছে। এই দুই উদাহরণ থেকে এটা প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের সাথে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যে মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তা অনেক সময় তার নিজের দলও বুঝতে পারেনি। বিএনপি তার নেতৃত্বের কাঁধে দাঁড়িয়ে বহুবার সরকার গঠন করেছে। প্রধান বিরোধী দল হয়েছে, অথচ দলটি কখনোই তার মতো দ্বিতীয় শক্তিশালী নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি। এটি ছিলো তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মহাকাব্যের এক গভীর ট্র্যাজেডি। যদিও তার দীর্ঘ অসুস্থতার সময়ে তার সন্তান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের মাঝেও বেগম জিয়ার অনেকগুলো গুনাবলী দৃশ্যমান। কিন্তু সেগুলো তার আপোষহীনতা ও ত্যাগের সাথে তুলনা করলে অনেক কম বলা চলে। যেখানে তিনি ছিলেন আকাশের মত বিশাল দৃঢ়চেতা মনের অধিকারীনি, সুবিশাল পর্বতের চূড়ার মত কঠিন সাহসিকতার প্রতীক, কিন্তু তার অনুসারীরা ছিলো পাদদেশে দাঁড়ানো। তিনি বেশিরভাগ দু:সময় ও সংকটে দলকে শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে টেনে তুলেছেন প্রতিকূলতার পাহাড়ে, কিন্তু সেই দলের ভেতরে অনেকে বুঝতেই পারেনি কোন উচ্চতায় বিএনপি দাঁড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা থাকত আরও শক্তিশালী, যদি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাকে এত দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে না রাখত। অসংখ্য রাজনৈতিক মামলা, দীর্ঘ  কারাবাস, গৃহবন্দিত্ব এগুলো তাকে দমাতে কিংবা তার মনোবল ভাঙতে পারেনি, কিন্তু দেশের সুস্থ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। একজন সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, কয়েকবার নির্বাচিত বিরোধী দলের নেতা এবং দেশের এক বৃহৎ রাজনৈতিক সমর্থনকারী দল বিএনপির সকল স্তরের আস্থার প্রতীককে দীর্ঘকাল চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করে রাখা, তার রাজনৈতিক ন্যায্য অধিকারের অপ্রাপ্তি ও অবরোধের মধ্যে রাখা রাষ্ট্রের মানবিক ও নৈতিকতার কাঠামোকে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

তার শারীরিক অবস্থা আজ অনেক বেশি সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ একটি সংবেদনশীল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের আপামর সাধারণ জনগণের সাথে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও সকলের নিকট রোগমুক্তির জন্য দোয়া কামনার মাধ্যমে তার প্রতি রাষ্ট্রের সম্মান ও শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের যেসব মুহূর্তে রাষ্ট্র তার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতাদের প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেসব মুহূর্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাগারে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকা মুক্ত হয়নি, অং সান সু চিকে বন্দি রেখে মিয়ানমার গণতন্ত্র পায়নি, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশেও বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দি রেখে রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ এই দীর্ঘ ১৭ বছর শক্তিশালী হয় নাই বরং ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।

বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এই রাজনৈতিক উদাহরণ প্রযোজ্য। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বীর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষক ও রাস্ট্রপতির স্ত্রী, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থতায় সংকটাপন্ন, দীর্ঘ রাজনৈতিক মামলা হামলা জেল জুলুম ও নিপীড়নের শিকার নেত্রীর রোগমুক্তির জন্য দোয়া চাওয়া শুধু দল হিসেবে বিএনপির সমর্থকদের বিষয় নয়; এটি পুরো জাতির মানবতার প্রশ্ন। তিনি সুস্থ হলে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যেমন আশার আলো ফিরবে, তেমনই দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থাও খানিকটা নরম হবে—কমবে মাঠের উত্তেজনা, বাড়বে প্রতিপক্ষের প্রতি আস্থা।

বেগম জিয়ার সমস্যাকে কেবল স্বাস্থ্যগত সংকট হিসেবে দেখা উচিত নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও সংকট। কারণ এদেশের মানুষ যখন দেখে যে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও সুচিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাস রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্র তখন শুধুমাত্র ভোটের ব্যাপার থাকে না, এটি হয়ে দাঁড়ায় মানবিকতা, সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার এবং সমতার পরীক্ষাগার।

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ, ভোটের উত্তেজনা, দলীয় বিভাজন, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কঠোর অবস্থান ও অনিশ্চয়তা—সবকিছুই জনগণকে উদ্বিগ্ন করছে। একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য প্রয়োজন সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের পারস্পরিক সম্মান, মানবিক আচরণ এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য জাতির দোয়া শুধু ব্যক্তিগত শুভকামনা নয়, এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বাস্থ্য রক্ষার প্রার্থনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা রয়েছে এমন নেতাদের, যারা ক্ষমতা হারিয়েও মানুষের হৃদয়ে অমলিন থাকে। খালেদা জিয়া সেই তালিকার শীর্ষে অবস্থান করেন। তার সংগ্রামকে তুলনা করা যায় এক নক্ষত্রযাত্রার সঙ্গে—যেখানে আলো কখনো নিভে যায় না, কেবল সময়ের সঙ্গে বদলে যায় তার দীপ্তির রূপ। আজ তিনি অসুস্থতার অন্ধকারে থাকলেও তার রাজনৈতিক আলো এখনো জ্বলছে কোটি মানুষের ভেতরে।

বেগম খালেদা জিয়া কখনো যদি বিদায় নেন, তা কোনো সাধারণ বিদায় হবে না। বরং বাংলাদেশের ইতিহাস থমকে দাঁড়াবে, মানুষ ফিরে তাকাবে সেই আপোষহীন নারীর দিকে, যিনি রাজনীতির যত ঝড়ঝঞ্ঝা ও ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সয়ে এসেছেন। তার উপস্থিতি এক নক্ষত্রের মতো; আর তার প্রস্থানও হবে নক্ষত্রের মতোই। কিন্তু আমরা এখন তার সেই বিদায় চাই না। আমরা চাই তিনি ফিরে আসুন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যেন দেশের রাজনীতিতে পরিণতিবোধ ও মানবিকতার নতুন আলো জ্বলে ওঠে। দেশের প্রয়োজন তার সেই দৃঢ়তার, সেই প্রজ্ঞার, সেই সংগ্রামের। এইমুহূর্তে জাতির একটাই প্রার্থনা আল্লাহপাক বেগম খালেদা জিয়াকে সুস্থতা দান করুন, দীর্ঘায়ু দিন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে আরও একবার তার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হবার সুযোগ দিন।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ, ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

কেকে/ আরআই
আরও সংবাদ   বিষয়:  খালেদা জিয়া   বিএনপি  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হামজা-শমিতদের ম্যাচ থেকে ৪ কোটির বেশি আয় বাফুফের
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে যোগ দিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩
দশমিনায় মৎস্য মেরিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে প্রার্থনা সভা
ফটিকছড়িতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান
সাভারে টিভি সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরসি'র আত্মপ্রকাশ
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
বিএনপি নেতার পুকুরে বিষপ্রয়োগ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close