বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে না ফিরলে আইনি ব্যবস্থা      রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসিকে তফসিল দেওয়ার আহ্বান নাহিদের      খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা      অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে : উপদেষ্টা ফরিদা      প্রবাসীরা ৬০ দিনের বেশি দেশে থাকলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে      এভারকেয়ারের পাশে সেনা-বিমান বাহিনীর মহড়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ      শীত নিয়ে দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
প্রাণিসম্পদকে বাঁচাতে চাই ‘বিপ্লবী নীতি সংস্কার’
এম. সফিউল আজম চৌধুরী
প্রকাশ: শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:১৬ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য ও দ্রুত বর্ধনশীল অংশ হলো প্রাণিসম্পদ খাত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে দুই শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে প্রায় পনেরো থেকে ষোলো শতাংশ অবদান রাখা এ খাতটি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। 

দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এ খাতের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল, যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মাংস ও ডিম উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা নিঃসন্দেহে এক বিশাল সাফল্য। তবে এ অর্জনকে টেকসই করতে এবং ২০৪১ সালের উন্নত রাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণে এ খাতে সমন্বিত উদ্যোগ, নীতিমালার সংস্কার ও কঠোর তদারকি এখন সময়ের দাবি। 

পরিকল্পনা কমিশন এবং খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, এ খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, সহজ অর্থায়নের অভাব, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং মানসম্মত ভেটেরিনারি সেবার অপর্যাপ্ততা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের আরও সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

প্রাণিসম্পদ খাতকে একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং এর পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমে প্রযুক্তি ও গবেষণার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষম দেশীয় জাতের গবাদিপশু যেমন রেড চিটাগাং ক্যাটল এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট সংরক্ষণে একটি শক্তিশালী জিন ব্যাংক স্থাপন ও গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন, কারণ এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। এ ছাড়া উন্নতমানের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুত সম্প্রসারিত করতে হবে এবং বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খামারের বর্জ্যকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বায়োগ্যাস, বায়োগ্যাস স্লারি ও জৈব সার উৎপাদনে খামারিদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা উচিত। 

অন্যদিকে, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা একান্ত প্রয়োজন। গবাদিপশু ও পোল্ট্রির সংক্রামক রোগ দ্রুত শনাক্তকরণের জন্য ডিজিটাল ‘ডিজিজ সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ ও ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ককে আধুনিক ও সম্প্রসারিত করতে হবে। এর পাশাপাশি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভেটেরিনারি জনবলের ঘাটতি পূরণের জন্য দ্রুত নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভেটেরিনারি ডিপ্লোমাধারীদের মাধ্যমে ‘পশু স্বাস্থ্যকর্মী’ বা প্যারা-ভেট তৈরি করে গ্রামীণ পর্যায়ে তাদের সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে এন্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনে ‘গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘খাদ্য মান নিয়ন্ত্রণ’ পরীক্ষাগারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে হালাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধজাত পণ্য রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান অর্জনে খামারি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া উচিত।

প্রাণিসম্পদ খাতের অধিকাংশ খামারিই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তাদের উৎসাহ প্রদান ও ঝুঁকি কমাতে অর্থায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। কৃষি ঋণের মতো প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য স্বতন্ত্র একটি ঋণ নীতিমালা তৈরি করা হোক, যেখানে জামানাতিমুক্ত ও স্বল্প সুদের, যেমন পাঁচ শতাংশের নিচে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুবিধা থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগের কারণে খামারিদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হলে, তা মোকাবিলার জন্য সরকারের উদ্যোগে একটি ‘প্রাণিসম্পদ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করা উচিত। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে, প্রতিটি গ্রামে স্থানীয় পর্যায়ে একজন প্রশিক্ষিত পশু স্বাস্থ্যকর্মী বা উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে এবং গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের, যারা মূলত হাঁস-মুরগি, ছাগল ও ছোট আকারের ডেইরি খামার পরিচালনা করেন, ঋণে বিশেষ সুদ মওকুফ এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক পশুবিমা কার্যক্রম চালু করা জরুরি, যা খামারিদের গবাদিপশুর মৃত্যুজনিত আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে।

পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য এ খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তাই ফিড উপকরণের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পোল্ট্রি, ফিশ ও ডেইরি ফিড তৈরির প্রধান কাঁচামাল আমদানির ওপর থেকে সব প্রকার শুল্ক ও কর সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে শূন্য শুল্ক নীতি চালু করা হোক। পাশাপাশি, ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ শিল্প ভর্তুকি প্রদান করা উচিত, যা উৎপাদন খরচ কমিয়ে ফিডের দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে। দেশীয় কাঁচামাল উৎপাদন জোরদার করতে ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো ফিড উপকরণের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পশুখাদ্যের উৎপাদন মূল্য, ডিলার কমিশন ও খুচরা মূল্য নির্ধারণে একটি স্বচ্ছ ‘ফিড প্রাইস রেগুলেশন পলিসি’ তৈরি করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। ভেজাল ও নিম্নমানের ফিড উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করাও জরুরি।

এ খাতের মূল সমস্যাগুলো খামারিদের মতামতেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন চট্টগ্রামে জনৈক ডেইরি খামারি বলেন, ব্যাংকের ঋণ পেতে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় এবং জামানত দিতে হয়। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, গরু অসুস্থ হলে উপজেলা থেকে ডাক্তার আসতে চায় না, তাই গ্রামে একজন প্রশিক্ষিত লোক চান তিনি। 

অন্যদিকে, একজন মহিলা পোল্ট্রি খামারি জানান, ফিড কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হওয়ার করুণ কাহিনির কথা বলেন এবং তিনি মনে করেন সরকার ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দিলেই তাদের খরচ অনেক কমে যায়। একজন  ছাগল পালক জানান, দেশি জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি হলেও, ভালো ব্রিডিংয়ের পাঠা পাওয়া কঠিন বলে জানান। তিনি চান সরকার গ্রামে গ্রামে দেশীয় জাতের প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করুক। অপর একজন গরু মোটাতাজাকরণ খামারি জানান, কুরবানির ঈদের আগে একদল দালাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তাই খামারিরা ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে একটি সরকারি ক্রয় কেন্দ্র বা বাইয়িং সেন্টার দরকার বলে মনে করেন।

সবকিছু বিশ্লেষণ করে বলা যায়, প্রাণিসম্পদ খাত টেকসই উন্নয়নের পথে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে, যদি সরকার এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ করে। এর ভিত্তিতে, সরকারের জন্য পাঁচটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। 

প্রথমত ফিড উপকরণের শুল্ক ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে এনে পশুখাদ্যের মূল কাঁচামাল আমদানিতে শূন্য শুল্কনীতি এবং ফিড কারখানায় বিশেষ শিল্প ভর্তুকি দিতে হবে; পাশাপাশি, পশুখাদ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে একটি প্রাণিখাদ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত ভেটেরিনারি ও ঋণসেবা সহজ করতে প্রতিটি ইউনিয়নে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বা ডোর-টু-ডোর সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য জামানতবিহীন স্বল্প সুদের বিশেষ ঋণ প্যাকেজ চালু করতে হবে। 

তৃতীয়ত পশুবিমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ বিমা প্রকল্প এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিপূরণের জন্য জরুরি তহবিল গঠন করা জরুরি। চতুর্থত দেশীয় জাতের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী জিন ব্যাংক স্থাপন এবং এর গবেষণা ও উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। 

পঞ্চমত বাজার মনিটরিং ও মূল্য শৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী বাজার মনিটরিং সেল গঠন করা দরকার  এবং কুরবানির সময় ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। 

এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ শুধু নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও প্রাণিজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  প্রাণিসম্পদ   বাঁচাতে   বিপ্লবী নীতি সংস্কার  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হামজা-শমিতদের ম্যাচ থেকে ৪ কোটির বেশি আয় বাফুফের
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে যোগ দিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩
দশমিনায় মৎস্য মেরিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে প্রার্থনা সভা
সাভারে টিভি সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরসি'র আত্মপ্রকাশ
ফটিকছড়িতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
বিএনপি নেতার পুকুরে বিষপ্রয়োগ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close