বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরেই কাঠামোগত দুর্বলতায় ভুগছে- এ অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য যে চিত্র তুলে ধরছে, তা কোনো সাধারণ খাতসংশ্লিষ্ট সমস্যা নয়; বরং একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের পূর্ণ রূপ। উচ্চ সুদহার, মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও বিনিয়োগ-অবসাদের জটিল সমাবেশই আজ দেশের অর্থনীতিকে এক ধরনের বিষাক্ত চক্রে আটকে ফেলেছে।
ব্যাংকগুলোকে তারল্য সংকটে উচ্চ সুদহার বজায় রাখতে বাধ্য হতে হচ্ছে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে, ফলে শিল্পায়ন মন্থর হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, আর মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত পরিবারের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের অনুমান অনুযায়ী, পুনর্গঠিত, পুনঃতফসিলকৃত ও খেলাপি ঋণসহ মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি- এটি শুধু উদ্বেগের নয়, বরং একটি ভয়ংকর বিপদের সতর্কবার্তা।
সেমিনারে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেছেন করনীতি ও শাসনব্যবস্থার গভীর সমস্যা। ড. ওয়াসেল বিন সাদাত যথার্থভাবেই বলেছেন- সৎ করদাতারা আজ শাস্তির মুখে, আর এ কারণেই অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে রয়ে গেছে। অর্থনীতি যখন এভাবে ছায়া-ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তখন কোনো সংস্কারই ফলদায়ক হয় না। করনীতি প্রণয়নে আমলাদের একক নিয়ন্ত্রণ কাক্সিক্ষত নয়; বরং রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও স্টেকহোল্ডারদের যৌথ যুক্তিবোধ সেখানে প্রতিফলিত হওয়া জরুরি। কর্মসংস্থান ঘাটতি এবং দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাবকে পরবর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে উদ্ভূত সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হবে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান না হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত মাত্রা আড়ালে থেকেই যেত। অর্থাৎ বহু বছর ধরে ব্যাংক খাতে গোপন ক্ষত সঞ্চিত হচ্ছিল, যা নীতিনির্ধারকরা ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, দেশের জনগণের চোখ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশ উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন বিনিয়োগ,– নিম্ন প্রবৃদ্ধির ফাঁদে আটকে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এই চক্র ভাঙতে কঠোর খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা, করনীতিতে ন্যায় ও স্বচ্ছতা, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। উচ্চ সুদ, মুদ্রাস্ফীতি ও শক্তি সংকট একসঙ্গে কাজ করছে; ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পড়েছে উল্লেখযোগ্য অনুপাত। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান বাড়াতে, শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ও শিল্প ক্ষেত্রকে বৈচিত্র্যময় করতে সরকারকে আরও উদারনীতি গ্রহণ করতে হবে। নীতিগত কিংবা বাস্তব কোনো পদক্ষেপ না নিলে বর্তমান পরিস্থিতি শ্রমবাজার ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও আরো ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এশিয়ার অন্যান্য দেশ এরকম সংকট কাটাতে যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল তা আমলে নেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৭ সালের এশিয়ান আর্থিক সংকট ও ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় যে ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশকে এখন সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। উদার ও ব্যবসাবান্ধব নীতি সংস্কার ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
কেকে/এমএ