ছবি তোলা তার কাছে নেহায়েতই শখ নয়। এটা তার প্যাশন। ব্যয়বহুল তো বটেই। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। কখনো বন, নদী অথবা পাহাড়, পর্বত কিংবা অতি দুর্গম এলাকা। যেখানে বিষধর সাপ বিচ্ছু আর নানা বন্যপ্রাণীর অবাধ আনাগোনা। এমন সব ঝুঁঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্যামেরার লেন্সে একের পর এক ছবি এঁকে চলছেন। অপার সৌন্দর্যের মুহূর্তগুলো ধরে রাখছেন তার ছবিতে। সুন্দর সব ছবি দিয়ে মুগ্ধতা ছড়ানো এ মানুষটির নাম আকলিমা আক্তার। তবে ডাকনাম পুষ্প। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে লালমাটিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেছেন তিনি। একটি স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি একটুখানি সময় বের করে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েন। পুষ্প একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার।
ফুল-পাখি, গাছপালা, প্রকৃতির আশ্চর্য বিষয়গুলো বরাবরই তার খুব প্রিয়। এই প্রিয় বিষয়গুলো ধরে রাখতে প্রথমে ব্যবহার করেছেন অপ্পো ফোন। এটা ২০১৬-১৭ সালের ঘটনা। এরপর ছোট ভাইয়ের পুরোনো ক্যামেরা নিকন ডি৯০ হাতে পেয়ে ছবি তোলার গতি যেন তার আরো বেড়ে গেল। যত ছবি তোলেন। ততই তার ভালো লাগা বাড়তে থাকে। প্রকৃতিকে, প্রাণীকে ক্যামেরায় ধরে রাখার আনন্দ তার দেখে কে। ধীরে ধীরে ছবি তোলা হয়ে যায় তার ধ্যানজ্ঞান। বর্তমানে তিনি ক্যানন আর ৭ (১০০-৪০০ লেন্স) ব্যবহার করেন।
মূলত ছবি তুলতে তুলতেই এর নানা রকম টেকনিক শিখেছেন তিনি। তবে সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়েছেন যখন প্রয়োজন মনে করেছেন। আর আলোর ইশকুল থেকে একটা শর্ট ট্রেনিং সম্পন্ন করেন তিনি, সঙ্গে ছিলেন একমাত্র ছেলে। পুষ্প মনে করেন, আসলে ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি হাতেকলমে শেখাও খুব জরুরি। প্রসেসিংয়ের জন্য হাতেকলমে শেখার আসলে কোনো বিকল্প নাই।
খোলা প্রান্তর, বিস্তীর্ণ মাঠ, নদী কিংবা হাওরের ঘোলা পানি পুষ্পকে প্রচণ্ড রকম টানে। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো এর পাখপাখালি। হরেক রঙের, হরেক নামের, হরেক ডাকের, সৃষ্টিকর্তার সুন্দর এই সৃষ্টির টানে বারবার ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে। পুষ্পের ছবির প্রধান বিষয় হলো পাখি। এর মানে আবার এই নয় যে, তিনি শুধু পাখির ছবিই তোলেন। সুন্দর যা কিছু চোখে পড়ে তাই ক্যামেরা বন্দি করেন তিনি। হতে পারে সেটা কোনো ঘাস ফুল, বাগানের ফুল, গাছের পাতায় বসা রঙিন প্রজাপতি কিংবা গ্রামের দৃশ্যপট। মনের শান্তির জন্য ছবি তোলেন পুষ্প। ছবি বিক্রি, প্রদর্শনী, প্রচারণায় তার মনোযোগ কম। তারপরেও বাংলাদেশের অনেক সংবাদপত্রে তার ছবি ছাপা হয়েছে। কিছু ছবির প্রদর্শনীতেও তার ছবি স্থান পেয়েছে।
পুষ্পদের মতো ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের জন্য অনেক সময় পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একান্নবর্তী পরিবার হলেও পুষ্পের পরিবার বাধা দেয়নি। কারণ সামাজিক মান মর্যাদা ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রেখেই ছবি তুলছেন পুষ্প। পরিবার তার সবকিছুকে সমর্থন দিয়েছে।
একজন নারী হিসেবে ওয়াইল্ডলাইফের ছবি তোলা অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। ঘরে বাইরে উভয় জায়গায়ই। পুষ্প বলেন, নারী হিসেবে তাই আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের সহযাত্রী কে বা কারা সেটা খেয়াল রাখতে হয়। কিছু জায়গায় রাতে চলাচল করা যাবে কিনা, কোথায় কোন হোটেলে থাকব সেটা নিয়েও মাথা ঘামাতে হয়। কারণ একে আমরা নারী সেই সঙ্গে আমদের সঙ্গে থাকে দামী ক্যামেরা।
পুষ্পদের একটি ছবি তোলার দল আছে। যেখানে মোট সদস্য ৫ জন। সবাই নারী। প্রথমদিকে মৌসুমি সিরাজ আর পুষ্প মিলে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। এরপর এদের দলে যোগ দেন রেহানা, লাবণ্য, সফিয়া। দলবব্ধ হবার কারণে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, থাকা, বিপদ মোকাবিলা করা সব কিছু অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
লিটিল টার্ন পুষ্পের একটা পছন্দের পাখি। সাদা কালো পাখির কমলা রঙের পা আর ঠোঁট। এই পাখি পদ্মার চরে খোলা আকাশের নিচে ডিম পাড়ে, তা দেয়, বাচ্চা ফোটায় আর বড় করে। প্রায় প্রতি বছর ওই সুন্দর দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করতে রাজশাহী যান পুষ্প। পাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটা আর মা পাখি-বাবা পাখি মিলে সেই বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর দৃশ্য যখন প্রথমবার দেখেন পুষ্প। আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। সিজনের সময় আম, লিচু গাছে চিকন ফাসের নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই নেটে আটকে পড়ে অনেক পাখি মারা যায়। ছবি তুলতে গিয়ে মৃত পাখি ঝুলে থাকতে দেখে অনেক মন খারাপ হয় পুষ্পের। আবার বিভিন্ন ঘের কিংবা চাষ করা পুকুরের উপর নেটে বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙাগুলোকে জীবন্ত কিংবা মৃত অবস্থায় ঝুলতে দেখা পুষ্পদের জন্য অনেক বেদনার।
ছবি তোলা একটা ব্যয়বহুল শখ। কারো কারো জন্য প্যাশন। কিন্তু অবসর সময় অলস না কাটিয়ে ছবির জগতে হারিয়ে যাওয়া নেহায়েতই মন্দ নয়। পুষ্পের মতে, ছবি তোলার কারণে যুবকদের একটা অংশ আজ অন্যান্য বদ অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে পারছে। দেশ বিদেশের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার লাভ করছে। যা দেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের।
কেকে/এমএ