দুই দশক আগেও সিলেটে ব্যবসায়-বাণিজ্যে নারীদের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। এখন সেখানে তৈরি হয়েছেন হাজারো নারী উদ্যোক্তা। অনেকেই পেয়েছেন সফলতা। কারো কারো ব্যবসায়ের পরিধি তো সিলেটের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন, উইমেন চেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় কী পরিমাণ নারী ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তা আছেন, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান কোথাও সংরক্ষিত নেই। তবে চার জেলায় হাজারো নারী উদ্যোক্তা আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের বাইরে আবার অনেক নারী অনলাইনে কিংবা বাসাবাড়িতে থেকেও ব্যবসায় করছেন। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত হাজার নারী ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত আছেন।
সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি লুবানা ইয়াসমিন বলেন, একটা সময় শুধু পোশাক, পার্লার ও টেইলার্সকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যেই নারীদের দেখা যেত। এখন নারীরা প্রায় সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে রেস্তোরাঁ, বুটিকস, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, ক্যাটারিং, ঠিকাদারি, আইটি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, চিকিৎসা উপকরণ বিক্রি, ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং ও খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা উল্লেখযোগ্য।
উইমেন চেম্বারের সভাপতি আরো জানান, দুই দশক ধরে ধীরে ধীরে সিলেটে ছোট ও মাঝারি শিল্পে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়ে চলছে। নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরা ব্যবসায় এগিয়ে চলেছেন। তবে নারী উদ্যোক্তাদের আরো উৎসাহিত করা গেলে সিলেটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বদলে যাবে।
নারী উদ্যোক্তার মধ্যে একজন ষাটোর্ধ্ব রায়হানা খানম (রেশমা)। তার বাসা নগরের শিবগঞ্জ মজুমদারপাড়া এলাকায়। তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটি (গ্রাসরুটস) সিলেটের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তার আছে ‘কুরশিকাঁটা গ্যালারি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। হাতে তৈরি কুরশিকাঁটার পোশাক, শোপিস, পুঁথির কাজ, ব্যাগ, নামাজের টুপি, ব্লকের থ্রি-পিসসহ নানা পণ্য তিনি এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করেন। অনলাইনেও তিনি এসব পণ্য বিক্রি করে থাকেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে রায়হানা বেগম কুরশিকাঁটার ব্যবসা করছেন। শুরুতে অল্প পরিসরে তার ব্যবসা শুরু। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ থেকে শুরু করে পরিবারের নানা খরচও তার ব্যবসার আয়ে হতো। এখন সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত। সন্তানদের কেউ প্রবাসে থাকেন, কেউ ব্যাংকে চাকরি করেন। এখন আর সেই অর্থে সংসার তার আয়নির্ভর নয়। তবে স্বামী মুজিবুল হকের পাশাপাশি একসময় তিনি ব্যবসার আয় সমানতালে পরিবারের কাজে ব্যয় করেছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সংসার চালানোর কারণেই তার পরিবারে সচ্ছলতা এসেছিল।
রায়হানা বেগম জানান, ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে কুরশিকাঁটা শিখেছিলেন। তখন থেকেই সেলাই মেশিন চালাতেন। পরে এ মাধ্যমকেই তিনি ব্যবসার কাজ হিসেবে বেছে নেন। কুরশিকাঁটার পাশাপাশি নানা শোপিস পণ্য তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। মানুষজনও তার কাজ পছন্দ করতে থাকেন। এরপর চলতে থাকে তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ব্যবসা চালুর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সফলতা পান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রায়হানা নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। এর মধ্যে শাড়ি, জামা, কাপড়ের জুতা, টুপি, বাচ্চাদের কটি, টেবিল ক্লথ, কুশন কভার, নানা নকশার ব্লকের পোশাক, শোপিসের মধ্যে ফুল, পুঁথির মালা ও ব্যাগ, চুড়ি, ময়না, মুরগি, খরগোশ, পেঙ্গুইন, বিড়াল উল্লেখযোগ্য। হাতে তৈরি এসব পণ্য আগে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা তার কাছ থেকে কিনতেন। তবে করোনা-পরবর্তী অনলাইনে তার একটা বিশাল ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এখন প্রতি মাসে অনলাইনে তিনি বিভিন্ন পণ্যের আগাম চাহিদা পান।
রায়হানা বেগম বলেন, তিনি নিজের নকশাতেই পোশাক তৈরি করেন। অনেক সময় অস্থায়ীভাবে কর্মী নিয়োগ দিয়েও করান। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরের ৫ থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠানে পাইকারি দরে তার পণ্য বিক্রি করে থাকেন। আগামী ১ ডিসেম্বর নগরের শিবগঞ্জে তিনি একটা শোরুম চালু করবেন। পরে সেখান থেকেই পণ্য বিক্রি করবেন। বিদেশ থেকেও এখন অনেক সময় তার পণ্যের চাহিদা আসে।
ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শেখা কুরশিকাঁটা কাজ যে রায়হানার জীবনে এভাবে সফলতা হয়ে ধরা দেবে, এটা তার কল্পনায়ও ছিল না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১৩ সদস্যের পরিবার আমার। এখন সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত, চাকরিবাকরি করে। পরিবারে আমার আয়ের টাকা আর দিতে হয় না। তবে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও আয় করে একসময় সংসার চালিয়েছি, সন্তানদের মানুষ করেছি, এটা ভাবলেই তো মনে একটা তৃপ্তি আসে।’
বাড়ছে নারীর কর্মসংস্থান
সিলেট নগরের শাহি ঈদগাহ হাজারীবাগ এলাকার নারী উদ্যোক্তা রুনা বেগম (৩৭) জানান, ‘নকশিকাঁথা’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মাধ্যমে তিনি সিলেট নগরের বিভিন্ন দোকান ও বিপণিবিতানে পাইকারি দরে প্রতি মাসে হাতে তৈরি কয়েক হাজার নকশিকাঁথা ও বিছানার চাদর সরবরাহ করেন। এসব কাঁথা ও বিছানার চাদর তিনি বিভিন্ন নারীকে দিয়ে সেলাই করান। এ কাজে তার অধীনে প্রায় ৪০০ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
রুনা জানালেন, শৈশবে মায়ের কাছে তিনি সেলাই শিখেছিলেন। সংসারের অভাব দূর করতে ২০০৮ সালে কাঁথা সেলাই করে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। শুরুর দিকে সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার একটি দোকানে নকশিকাঁথা পাইকারি দরে বিক্রি করতেন। পরে সেসব কাঁথা নগরের লালদীঘির পাড়, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার দোকানে সরবরাহ করতে থাকেন। বড়দের ও বাচ্চাদের নকশিকাঁথার পাশাপাশি বিছানার নকশি চাদর ও মেয়েদের জামাও তৈরি করে পাইকারি দরে বিপণন করা শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তার নিজস্ব নকশায় তৈরি কাপড়ের বড় বাজার তৈরি হয়। দেড় দশকের ব্যবধানে তিনি এখন সফল নারী উদ্যোক্তা।
ব্যবসায়ে কীভাবে জীবন বদলে গেল, সে কথা বলতে গিয়ে রুনা বেগম বলেন, ‘ব্যবসায় সফলতা আসায় সবাই সম্মান করেন, সমীহ করেন। যারা আগে বাঁকা চোখে দেখতেন, এখন তারাও প্রশংসা করেন। কানকথা দূরে রেখে লেগে থাকলে সফল হওয়া যায়, এইটা নিজ জীবনেই দেখলাম!’
একাধিক নারী উদ্যোক্তা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় নারীদের কর্মসংস্থানও আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী সময়ে সিলেটে নারীদের ব্যবসায় অংশগ্রহণ বাড়ায় অন্য নারীদেরও কাজের সুযোগ তৈরি হয়। এটি সিলেটে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত দুজন নারী বলেন, আগে একজন নারী যখন ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেন, তখন শুরুতেই তাকে পারিবারিক ও সামাজিক নানা বাধার মুখে পড়তে হতো। ওই নারীকে সামাজিক কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মোকাবিলা করতে হতো। এ ছাড়া পুঁজিসংকটের বিষয়টি তো ছিলই। এ ছাড়া ব্যাংক ও পাইকারি বাজারে যোগাযোগের অপর্যাপ্ততাও ছিল। তবে অবস্থা এখন অনেকটাই বদলেছে। সিলেট জেলাতেই এখন উদ্যোক্তা হিসেবে অন্তত দুই থেকে তিন হাজার নারী আছেন।
কেকে/এমএ