তিন বছর বয়সী মেয়ের নামেই মায়ের উদ্যোগ- আনাবিয়া। জামদানিকে সার্বজনীন করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছেন আনাবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা নাদিয়া পারভীন জুথী। দেড় বছর আগে ৩০ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করা এই উদ্যোগের এখন মাসিক টার্নওভার প্রায় ৬-৭ লাখ টাকা। অথচ উদ্যোগ শুরুর কিছুদিন আগেই নতুন মাতৃত্বের ভার আর মহামারির স্থবিরতায় ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্রী জুথী পড়াশোনার পাশাপাশি কো-কারিকুলার কার্যক্রমেও ছিলেন বেশ সক্রিয়। পিরোজপুরে স্কুল জীবন থেকেই আবৃত্তি ও নাচের পাশাপাশি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ছিলেন পরিচিত মুখ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও বিতর্কে পেয়েছেন নানা পুরষ্কার। ২০১৮ সালে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন।
বছরখানেক শিক্ষকতার পর ২০১৯ সালে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন জুথী। সন্তান কিছুটা বড় হয়ে উঠলে এক বছর পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন কাজে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন- তখনই বিশ্বব্যাপী মহামারির প্রভাবে স্থবির হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এর পরবর্তী বছরখানেক সময় জুথীর জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার অন্ধকার।
নাদিয়া পারভীন জুথী বলেন, ক্যারিয়ার নিয়ে সবসময়ই সচেতন ছিলাম আমি। জীবনে বেকার বসে থাকার কথা কখনও ভাবতেই পারিনি। মাতৃত্বকালীন ছুটিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্যারিয়ারের স্বার্থে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। কিন্তু করোনায় যখন দেড় বছর ঘরে বসে থাকতে হয়, তখন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। ‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে’ও ভুগছিলাম সেসময়।
সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু করোনার কারণে সেগুলোর রেজাল্টও আটকে ছিল। এর মাঝেই কেউ কেউ খোঁচা দিয়ে কথা বলতেন ক্যারিয়ার নিয়ে। সেটাও অসহ্য লাগত। তখন নিজের প্রচেষ্টাতেই কিছু করার কথা ভাবলাম। ‘আনাবিয়া’ শুরু করার পেছনে ‘রিসাইকেল বিন’ নামের ফেসবুক পেজের অবিস্মরণীয় অবদান স্বীকার করেন জুথী। নিজেদের ব্যবহৃত বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস এই ফেসবুক গ্রæপের সাহায্যে বিক্রি করে দেয়া যায়।
জুথী বলেন, গ্রুপের শুরুর দিকে রিসাইকেল বিনে জামা-কাপড় বিক্রি করে দেয়ার একটা ট্রেন্ড চলছিল। তখন আমার একটা দামি জামদানি শাড়ি গ্রæপে বিক্রির জন্য পোস্ট করি। সেই শাড়ি বিক্রির পোস্টে অভাবনীয় সাড়া পাই। প্রায় আড়াই-তিন হাজার ম্যাসেজ আসে আমার ইনবক্সে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ থেকেও আমার সাথে যোগাযোগ করা হয় শাড়িটি সম্পর্কে তাদের আগ্রহ থেকে। কিন্তু ততক্ষণে সেই শাড়িটি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবু অনেকেই আমাকে অনুরোধ করছিলেন এরকম আরও শাড়ি থাকলে বিক্রি করে দিতে। তখন রিসাইকেল বিনের সদস্যরা অনেকেই আমাকে বলেন এমন নতুন শাড়ি থাকলেও তারা আমার কাছ থেকে কিনতে চান। সেই থেকেই জামদানি শাড়ি নিয়েই ব্যবসা শুরুর সাহস পেলাম। ছোটবেলা থেকেই শাড়ির প্রতি ভালোবাসা থাকায় অনেক দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহের পাশাপাশি অনেক তাঁতির সঙ্গে পরিচয় ছিল জুথীর। তাদেরকে কাজে লাগিয়ে নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়েই শুরু হয় আনাবিয়ার পথচলা।’
দেড় বছরে অনেক মানুষের সাথে পরিচয়ের পাশাপাশি আনাবিয়ার কাজের ক্ষেত্র বড় হয়েছে। সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠার পাশাপাশি অনেকবার হোঁচটও খেয়েছেন জুথী। কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে তার দৃঢ়প্রত্যয় সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে বারবার। আনাবিয়ার জন্য বর্তমানে ১৮০ জন তাঁতি মাসিক চুক্তিতে কাজ করেন। এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৪৫ হাজার টাকা মূল্যের নানান ডিজাইনের জামদানি স্টকে থাকে তাদের। এছাড়াও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী এক্সক্লুসিভ জামদানির প্রি-অর্ডার নিয়ে থাকেন। মার্কেটিং থেকে শুরু করে ডেলিভারি ও অন্যান্য সব বিষয়ে জুথীকে সাহায্য করেন তার বর। জুথীর মেয়ে আনাবিয়াও মায়ের কাজ নিয়ে বেশ উৎসাহী।
মায়ের কাজে যথাসম্ভব সাহায্য করে ছোট্ট আনাবিয়া। মাঝেমধ্যে বাচ্চাকে ঠিকমতো সময় দিতে না পারায় অপরাধবোধে ভোগেন জুথী। কিন্তু, তিনি মনে করেন তার ক্যারিয়ার ঠিক না থাকলে সেটা বাচ্চাকে এক ধরনের খারাপ বার্তা দিত। তার মেয়ে তাকে দেখে যেন ইতিবাচক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে সে চেষ্টাই করেন তিনি।
বাংলাদেশের ৬১টি জেলাসহ বাইরের ২২টি দেশে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে আনাবিয়ার পণ্য। “সাধ্যের মধ্যে জামদানি” স্লোগান নিয়ে কাজ করা জুথীর লক্ষ্য জামদানিকে সব শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। শুধু শাড়িতেই নয় ফ্যাশনের অন্যান্য সব অনুষঙ্গেও জামদানির প্রচলন শুরু করতে চান তিনি। জামদানির গাউন, বাচ্চাদের ফ্রক, লেহেঙ্গা, মাস্ক, গয়না ইত্যাদি বানানোর কাজ শুরু করেছেন।
ব্যবসায় নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতার কথা জানালেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক সুবিধার কথাও স্বীকার করেন জুথী। নিজের উদ্যোগে ব্যবসায় করলে নিজের কাজের সময়কে সুবিধামতো ভাগ করে সন্তানের কাছাকাছি থাকা যায় অনেকটা সময়। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নানা বিশেষায়িত ফেসবুক গ্রুপ, সংস্থাও তার ব্যবসায় অনেক বড় সহযোগী।
কেকে/এমএ