ঢাকায় প্রথমবারের মতো দেশের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-খতিবদের নিয়ে বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘সম্মিলিত ইমাম-খতিব জাতীয় সম্মেলন ২০২৫’। সম্মেলনে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সব ধর্মের অধিকার সংরক্ষণ করে ইসলামি শরিয়াহকে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহ ৭ দফা দাবি জানানো হয়েছে। রোববার (২৩ নভেম্বর) দুপুর ২টায় রাজধানীর আগারগাঁও চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাকী। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মুফতি আজহারুল ইসলাম ও মুফতি শরিফুল্লাহ।
সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে মহানবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণে ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে বিএনপি। এ ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং বর্তমান আইনের মধ্যে এমন কিছু থাকলে তা বাতিল করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থে ইসলামি স্কলারদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে, যা ধর্মীয় ব্যাখ্যার অপব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, ভিন্নমত যেন ফিতনা ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি না করে, সেদিকে আলেম-ওলামাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতা নিশ্চিত করবে বিএনপি।
এদিকে ইসলামের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, অতীতে বারবার উলামায়ে কেরামের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে স্বার্থ হাসিল করেছেন, উলামায়ে কেরামকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই সুযোগ আর কেউ যেন নিতে না পারে সেই বিষয়ে উলামায়ে কেরামকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
রেজাউল করীম বলেন, অতীতে উলামায়ে কেরামকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। খুন-গুম-মামলা-মোকদ্দমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। বর্তমানে ইসলামের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা ইসলামের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ইমাম-খতিবদের দাবি সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ যদি সুযোগ দেন তাহলে আপনাদের খাদেম হিসেবে আপনাদের দাবি-দাওয়া পূরণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
যেদিন নামাজের ইমাম সমাজের ইমাম হবেন, সেইদিনই সত্যিকারের মুক্তি মিলবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সমাজের ফায়সালা মসজিদের মিম্বার থেকে হবে। আমাদের ইমাম এবং খতিব সাহেবেরা কারও করুণার পাত্র হবেন না। খতিব-ইমামদের আসল মর্যাদা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা যখন জীবিত আছি, তখন ইমাম-খতিবরা ইমামতি করবেন, আমরা তাদের পেছনে দাঁড়াই। দুনিয়া থেকে চলে গেলে আমাদের লাশের সামনে দাঁড়াবেন তারা। হায়াতেও ইমাম, মউতেও ইমাম। আমরা আজীবন তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চাই।
সম্মেলনে উপস্থাপিত অন্য ছয় দাবি হচ্ছে- ২. রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে ইমাম-খতিবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটি, গ্রাম আদালত, দুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটি এবং ইউনিয়নভিত্তিক সেবা কার্যক্রমে ইমাম-খতিবদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ৩. সব মাদ্রাসার বিদ্যুৎ বিল মসজিদের ন্যায় ডি-ট্যারিফের আওতায় আনতে হবে এবং সব মসজিদ ও মাদ্রাসার পানি বিল ৫০ শতাংশ মওকুফ করতে হবে।
৪. দেশের সব মসজিদের ইমাম-খতিব, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের জন্য পৃথক চাকরি বিধি প্রণয়ন করতে হবে এবং প্রতিটি মসজিদ কমিটিতে ইমাম-খতিবকে পদাধিকারবলে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের বিধান করতে হবে। ৫. উপযুক্ত প্রমাণ ও সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া কোনো ইমাম-খতিব বা আলেমকে গ্রেফতার বা হয়রানি করা যাবে না। ৬. দাওরায়ে হাদিসসহ সরকার স্বীকৃত সনদপ্রাপ্ত আলেমদের সরকারি মসজিদের ইমাম-খতিব, স্কুল-কলেজের ধর্মীয় শিক্ষক এবং কাজি হিসেবে নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৭. ওয়াকফ সম্পত্তির আয়ের অপচয় রোধে প্রচলিত ওয়াকফ প্রশাসন আইনকে বিশেষজ্ঞ মুফতি ও ইমাম-খতিবদের সম্পৃক্ত করে শরিয়াহর আলোকে যুগোপযোগী করতে হবে। একইসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি এবং শিক্ষা কমিশনে বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম ও ইমাম-খতিবদের সম্পৃক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
সম্মেলনে শীর্ষ আলেমদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাফেজ মাওলানা আব্দুর হক, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, শাহ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন ও মাওলানা আব্দুল হাই নদভীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বহু আলেম।
সম্মানিত ইমাম-খতিবদের মধ্যে আরো ছিলেন ড. খলিলুর রহমান মাদানী, মুফতি আবু সাঈদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান মমতাজি, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আব্দুল হাই মিশকাত ও মুফতি বশিরউল্লাহ।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা সারোয়ার কামাল আজিজী, মাওলানা আব্দুল কাদের, মাওলানা আবদুর রহিম ইসলামাবাদী, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, মাওলানা আব্দুল আওয়াল, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সোবাহানী, মুফতি আব্দুল কাইয়ুম কাসেমী ও মুফতি রেজাউল করিম আবরারসহ অন্যান্য শীর্ষ আলেম-ওলামা।
সম্মিলিত ইমাম-খতিব জাতীয় সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী ও সদস্যসচিব মুফতি আজহারুল ইসলামের সঙ্গে বাস্তবায়ন কমিটিতে কাজ করেন মুফতি আবদুর মালেক, মুফতি দেলোয়ার হোসাইন, মুফতি মুনীরুজ্জামান খান, ড. জয়নুল হক খান, মাওলানা জিয়াউল করিম মাহমুদ, মুফতি নেছার হুমায়ূন মাহনির, মুফতি শাব্বির আহমাদ মঞ্জিলী ও মুফতি শফিকুল ইসলাম।
কেকে/এআর