অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণ’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভাষণে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন-আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এ গণভোটে জনগণ চারটি মৌলিক প্রস্তাবের ওপর একটি মাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে মতামত জানাবেন।
এই চার প্রস্তাব মূলত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর ভিত্তিতে তৈরি। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠনের নতুন কাঠামো, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা, নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ভারসাম্যপূর্ণ করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ। বলা যায়, এগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ভারসাম্যে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সংবিধান সংশোধনের বেশিরভাগ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক স্বার্থে হয়েছে; জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত ছিল।
এ প্রেক্ষাপটে একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন- রাজনৈতিক সংস্কারকে জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার এক সাহসী উদ্যোগ। এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধান পুনর্গঠনের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই চারটি মৌলিক বিষয়কে ঘিরে একটি প্রশ্নে হ্যাঁ বা না ভোটের বিষয়টি সমস্যাজনক। এই চারটি বিষয়ে ব্যক্তি একমত নাও হতে পারেন, তিনি হয়তো তিনটি বিষয়ে একমত হলেন বাকিটাতে হলেন না কিন্তু এখানে তার সেই নির্দিষ্ট বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণের সুযোগ থাকছে না। ফলে এটি একটি কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে ব্যক্তি তার মতপ্রকাশে বাধ্য হচ্ছে। আরেকটি ব্যাপার হলো- গণভোটের প্রশ্ন ও প্রস্তাবগুলো যেন সাধারণ ভোটারের জন্য স্পষ্ট ও বোধগম্য থাকে- এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বোধগম্য করার দায়িত্ব যেমন সরকারের তেমনি দলগুলোরও।
এর বাইরেও কিছু শঙ্কা রয়ে গেছে। নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হলে প্রশাসনিক জটিলতা, ভোটগ্রহণে বিশৃঙ্খলা এবং তথ্যপ্রবাহের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোও ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ একে বলেছেন ‘প্রধান উপদেষ্টার নিজের সই করা সনদের লঙ্ঘন’, অন্যদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘গণদাবি উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তবে সবকিছুর বাইরে এই গণভোট হতে পারে রাজনৈতিক ঐকমত্যের নতুন ভিত্তি, যদি সরকার ও দলগুলো জনগণের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে সেটি শুধু রাজনৈতিক সংস্কারই হবে না বরং সেটি হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর নৈতিক পুনর্জাগরণ।
গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট অধিকাংশ হলে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যা ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন সংবিধান সংস্কারের খসড়া তৈরি করবে। এ কাঠামো কার্যকর হলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো জনমতের ভিত্তিতে তৈরি সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া দেখতে পাবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বহুবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে- কখনো স্বৈরশাসনের মাধ্যমে, কখনো ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রয়োগে। ‘জুলাই সনদ’ সেই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি না হয়ে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হোক এই প্রত্যাশা আমাদের সবার। অতএব, গণভোটের প্রশ্ন হোক স্বচ্ছ, প্রচারণা হোক নিরপেক্ষ, আর চারটি মৌলিক প্রস্তাবনাকে ঘিরে একটি মাত্র প্রশ্নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হলে গণভোটে জনগণের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন ঘটবে।
কেকে/এআর