কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের আজকের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ কর্মসূচি সামনে রেখে দেশজুড়ে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা নশকতা চালাচ্ছে পতিত শক্তিটি। কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল ও মশাল মিছিলও করেছে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা।
এদিকে আওয়ামী লীগের এ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ একাধিক স্থানে বাসে আগুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ হতে যাচ্ছে আজ ১৩ নভেম্বর।
রাজধানীজুড়ে ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অনেক কম দেখা গেছে। সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে। রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের তল্লাশি কার্যক্রমও জোরদার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্তে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ও গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের ও ৫০ জন গ্রেফতার করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত সোমবার দিবাগত রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ১২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ি এলাকায় আলম পরিবহন নামে একটি বাসে আগুনের ঘটনায় ঘুমন্ত অবস্থায় এক হেলপারের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী ও সোনারগাঁও জনপদ, ধানমন্ডি সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, বাড্ডা ও বসুন্ধরার ১০০ ফিট এলাকায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এর আগে বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে তিনজন আহত হন। মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে একইভাবে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। একইদিন ভোরে মোহাম্মদপুরে সরকারের একজন উপদেষ্টার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মঙ্গলবার মধ্যরাতে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের গেটে দুটি পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা।
ডিএমপি জানায়, রাজধানীতে নাশকতার অভিযোগে গত তিনদিনে ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে টাকার বিনিময়ে ঢাকার নাশকতার করার চেষ্টা করছে দাবি পুলিশের।
গত মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থেকে চোরাগুপ্তা মিছিল ও নাশকতার অপচেষ্টা করছে। অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ১৪টি ঝটিকা মিছিল হয়েছে এবং ৫৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ কমিশনার বলেন, এদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। টাকার বিনিময়ে তারা মিছিলে অংশ নেয়, তারপর ঢাকার বাইরে চলে যায়।’
রায় ঘোষণার দিন ঘিরে বাড়তি সতর্কতা : আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করা হতে পারে। পুলিশ বলছে, ওই দিন আদালতের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সকাল-সন্ধ্যা লকডাউন কর্মসূচি দিয়েছে। নাশকতা ঠেকাতে হোটেল, মেস ও গেস্টহাউসে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো আগন্তুককে আশ্রয় দেওয়ার আগে পরিচয় যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কঠোর অবস্থানে ডিবি, সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি : রাজধানীতে সাম্প্রতিক সহিংসতা, বিভ্রান্তিকর ভিডিও ছড়ানো ও উসকানিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গতকাল বুধবার মিন্টো রোডে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে বা অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হবে। গত ২৪ ঘণ্টায় আমরা ৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছি।’ তিনি জানান, কিছু ব্যক্তি রিকশাচালক বা সাধারণ পথচারীদের অর্থ দিয়ে স্লোগান দিতে বাধ্য করে ভিডিও তৈরি করছে। এসব ভিডিও পরে অনলাইনে ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা বিদেশে বসে এসব উসকানি দিচ্ছে, তাদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে।’
ঢাকার প্রবেশপথে চেকপোস্ট, যানবাহনে তল্লাশি : নিরাপত্তাব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঢাকার প্রবেশপথ আমিনবাজার এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকা জেলা পুলিশ। সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে স্থাপিত চেকপোস্টে ঢাকাগামী গণপরিবহন, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের গন্তব্য ও আগমনের স্থান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। তল্লাশির সময় যাত্রীদের ব্যাগপত্র ছাড়াও মোবাইলফোনের গ্যালারি ঘেঁটে কোনো সন্দেহজনক তথ্য বা উপকরণ পাওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ সদস্যরা।
চেকপোস্টে উপস্থিত সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জুয়েল মিয়া বলেন, ‘বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আমাদের এ তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, পাশাপাশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে টহল কার্যক্রমও বাড়ানো হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও থানায়-থানায় নিরাপত্তা জোরদার : গত কয়েক দিনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে, ডিএমপির ৫০টি থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট, সচিবালয়সহ প্রধান প্রধান সরকারি অফিসগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছেন।
ঢাকা ও আশপাশের জেলায় বিজিবি মোতায়েন : নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ ঢাকায় ১২ প্লাটুন ও আশপাশের জেলায় দুই প্লাটুনসহ মোট ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
কেকে/এআর