অনেকটা হঠাৎ করেই ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। এতে অভিজ্ঞ নেতারা যেমন আছেন, তেমনি বিপুলসংখ্যক তরুণ মুখও রয়েছেন। তবে কিছু কিছু আসনে বিতর্কিত, অযোগ্য ও হাইব্রিড নেতাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে তৃণমূলে হতাশা আর ক্ষোভ ঝরছে। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ-দুঃখে ফুঁসছেন। এরই মধ্যে বিতর্কিত এক নেতার প্রার্থিতা স্থগিত করেছে দলটি। অনেক আসনে প্রার্থিতা বদলের আন্দোলন এখনো চলছে। কোথাও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। এ ঘরোয়া দ্বন্দ্বের রাশ টানতে না পারলে অনেক আসন হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
প্রার্থী ঘোষণা পরদিন, অর্থাৎ গত মঙ্গলবার বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ থেকে অন্তত দশ জেলায় বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক-রেলপথ অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মেহেরপুরে দুপক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।
অভিযোগ রয়েছে, বেশ কয়েকটি আসনে তৃণমূলে জনপ্রিয় নেতাকে উপেক্ষা করে হাইব্রিড, উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম ঘনিষ্ঠদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাঠে রাজনীতিকদের চেয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সবসময় তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সৎ, জনপ্রিয় ও মাঠে নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে ওই আসনে পাস করে আসা সহজ। এ বাইরে যদি সুযোগসন্ধানীরা মনোনয়ন পায়, তাহলে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় এবং সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এর সুযোগ নেবে প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী। তার ভুল প্রার্থী বাছাইয়ে আসন হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগও এক সময় তার ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করে। তার বদলে দলটিতে প্রাধান্য পায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী, সুযোগসন্ধানীসহ রাজনীতির বাইরের ব্যক্তিরা। যারা নিজেদের স্বার্থে দলটিকে ব্যবহার করেছে। আর এতেই দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুতরাং কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের পথে হাঁটা যাবে না।
অবশ্য প্রার্থী ঘোষণার বিষয়টি ভালো হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘এখানে গুমের শিকার পরিবারের সদস্য আছেন, ছাত্রদল-যুবদলের নেতারাও মনোনয়ন পেয়েছেন। অর্থাৎ নবীন-প্রবীণের সমন্বয় হয়েছে। আমরা মনে করি, একটি ভালো মনোনয়ন হয়েছে।’
প্রার্থী ঘোষণার পর সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়াটি আসে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) থেকে। এ আসনে ‘হেভিওয়েট’ নেতা আসলাম চৌধুরীর বদলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপাতি কাজী সালাহউদ্দিনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আসলামের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন। এতে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আন্দোলনের পাশাপাশি গণপদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন। আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তার অনুসারীরা গত সোমবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ কারণে স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আলোচনায় ঢাকা-১৮ আসন : জুলাই আন্দোলনে দেশের আলোচিত শহিদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ সদ্য বিএনপিতে যোগদানের পর তিনি ঢাকা-১৮ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হতে পারেন—এমন জল্পনা-কল্পনা বইছে বৃহত্তর উত্তরাজুড়ে। এ আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা দেয়নি বিএনপি। তবে দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে স্নিগ্ধ বিএনপির সদস্য ফরম পূরণ করায় ঢাকা-১৮ আসনে পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে সে হিসাব। তবে মীর স্নিগ্ধের হঠাৎ বিএনপিতে যোগদানের পর বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। উত্তরার স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপিতে যোগ দিয়ে মীর স্নিগ্ধ ক্ষমতার রাজনীতির পেছনে ছুটছেন। জুলাই শহীদের ভাই হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতে তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকা-১৮ আসনে ভোটের মাঠে বিএনপির জেলখাটা ত্যাগী নেতাদের জনপ্রিয়তাই বেশি। এ আসন থেকে বিএনপি স্নিগ্ধকে মনোনয়ন দিলে স্থানীয় ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হবে। এ আসনে এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতা। তিনি মনোনয়ন পেলে আসনটি বিএনপির হাতে থাকবে বলে স্থানীয়দের অভিমত। কারণ স্নিগ্ধ জুলাই শহীদ মুগ্ধের ভাই হলেও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তার ওঠবস নেই।
এস আলম ঘনিষ্ঠরাও প্রার্থী :
বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদেরও মূল্যায়ন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে নোয়াখালী-৫ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামকে। তিনি এস আলম ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এক সময়ের এ জামায়াত নেতা ২০০৯ সালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছিলেন। তার মেয়ে ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি এবি পার্টির যুগ্ম সম্পাদক। অথচ এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আলোচিত ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহপল্লী উন্নয়ন ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ। বিগত দিনে তিনি এ এলাকায় এককভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তাকে মনোনয়নবঞ্চিত করায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে গত বছর ৫ আগস্টের পর এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যদিও বহিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে তার সাংগঠনিক শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। নেতাকর্মীরা জানান, এস আলম পরিবারের তদবিরেই এনামুলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তা আমলে নেননি দলের শীর্ষ নেতারা। অথচ এ আসনে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার সৈয়দ সাদাত আহমেদের মতো জনপ্রিয় নেতাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অসন্তোষ রয়েছে কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসনেও। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির বড় একটি অংশ এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা রংপুর বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও আব্দুল খালেককে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে তারা।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিমউদ্দিন মিলনকে। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থি নেতা ছিলেন। ২০১৮ সালে এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়ও। তাকে বাদ দেওয়ায় আসনটি বিএনপি তারাতে পারে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মত।
নেত্রকোনা-৩ আসন নিয়েও জটিলতা বাড়ছে। সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে রফিকুল ইসলাম হিলালীকে। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছেন অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। সেখানে সাবেক মেয়র ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া দুলাল নীরব ভূমিকা পালন করলে আসনটি হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা নেতাকর্মীর।
কেকে/এমএ