বরিশালের বানারীপাড়ার জলসীমায় চলছে আস্ত এক বিমান। সাধারণত বিমান সব সময় আকাশ পথে উড়তে দেখা যায়। যা আমরা এত দিন দেখে এসেছি। এক দেশ থেকে অন্য দেশ পাড়ি দিতে হলে ব্যবহার হয় উড়াল যান বিমান। তবে, এবার আকাশপথের বিমান চলছে বরিশাল জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে। বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিতে ও দেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে এই নৌযানটিতে লাগানো হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
এমন একটি বিমান তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি গোলাম মোস্তফা। উদ্ভাবনের পর বিমানটির নাম রেখেছেন সুবর্ণা এক্সপ্রেস-২
বানারীপাড়ার বিশারকান্দি ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি গোলাম মোস্তফা। দুই বছরের বেশি সময় ব্যয় করে তিনি তৈরি করেছেন অভিনব এক বাহন। যা দেখতে অনেকটা বিমানের মতো। দূর থেকে বিমান মনে হলেও এটি আসলে অবসর কাটানোর নৌযান।
প্রকৌশল শাস্ত্রে গোলাম মোস্তফার কোনো একাডেমিক জ্ঞান নেই। ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়েই যতটুকু শিখেছেন। লোহা-লক্করের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব প্রায় ২৭ বছরের। অজোপাড়ার এই মিস্ত্রি গতানুগতিক কাজে যখন হাঁপিয়ে ওঠেন, তখন নিজের মতো করে নতুন কিছু তৈরি করেন। কখনও কৃষকের জন্য, কখনো জেলের জন্য, কখনো নিছক আনন্দের জন্য।
ভিন্ন ধরনের এই বিমানটি আকাশ পথের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছেন জলপথের নদ-নদীতে। বিশারকান্দিতে গোলাম মোস্তফার চেয়ে মোস্তফা ফিটার বা ফাইন্ডার নামেই বিখ্যাত তিনি। ইঞ্জিনের দক্ষ মেকানিককে ফিটার বা ফাইন্ডর বলা হয়, সেইসূত্রেই মোস্তফা ফিটার বলে ডাকা হয় এই উদ্ভাবককে।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, চাইলেইতো আর বিমানে উঠতে পারতেছি না। বিমানে ঘুরে বেড়ানো ব্যয়বহুল। অনেক টাকা-পয়সা দরকার। অত টাকা আমি পাব কোথায়? চিন্তা করলাম বিমানে উঠার সক্ষমতা না থাকলেও নিজে একটা বিমানে তৈরি করি। যেটি নদীতে চলবে। নিজেও চড়তে পারলাম আর লোকজন বলবে বিমান আসছে। একেবারেই খেয়ালখুশিতে এটি তৈরি করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একসময় আমি অন্যের ওয়ার্কশপে কাজ করতাম। এখন চৌমুহনী বাজারে নিজের ওয়ার্কশপ আছে। কাজের চাপ না থাকলে স্টিল বা লোহা দিয়ে নিজের মনের মতোই কিছু তৈরি করি। এর আগে স্টিলের লাঙল বানিয়েছি। সাধারণত কৃষকরা ভালো ও মজবুত লাঙলের সংকটে থাকেন। তাছাড়া বছরে বছরে কাঠের লাঙল বদলাতে হয়। স্টিলের লাঙল দীর্ঘস্থায়ী। ধারালো হওয়ায় সহজেই গভীরভাবে জমি চাষ করা যায়।’
গোলাম মোস্তফা জানান, অনেক অঞ্চলে ধানের জমিতে পানির উচ্চতা বেশি হওয়ায় সাধারণ ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করতে পারে না। সঠিক সময়ে চাষ না দিলে ফসল উঠাতেও দেরি হয়। ভালো ফসলও পাওয়া যায় না। নিম্নাঞ্চলের কথা চিন্তা করে আমি ভাসমান ট্রাক্টর বানিয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় নদীর প্লেন তৈরি করি। ২০২২ সালে মাথায় চিন্তা আসে বিমান বানালে কেমন হয়? কিন্তু আকাশে উড়তে পারবে— এমন বিমানতো আমার দ্বারা বানানো সম্ভব না। বিকল্প হিসেবে বায়ুর জগত বাদ দিয়ে পানির জগতে বিমান তৈরির পরিকল্পনা করি। একটু একটু করে প্রায় দুই বছর কাজ করে বিমানটির কাজ শেষ করি।
‘প্রথমে মানুষ অনেক প্রশ্ন করতো, কী বানাচ্ছি? পূর্ণাঙ্গ করার আগ পর্যন্তও মানুষ ধারণা করতে পারেনি আসলে কী হচ্ছে। বিমানটি চলাচল উপযোগী করতে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি মনে করি, সঠিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমি মানুষের উপকারে আসে—এমন টেকসই বাহন উদ্ভাবন করতে পারব।’
১৮ জন যাত্রী নিয়ে ২৪ ঘণ্টাই নৌপথে চলাচলের সক্ষমতা রয়েছে গোলাম মোস্তফার বিমানের। ইঞ্জিনচালিত এই বাহনটি এখন পর্যন্ত নিজেই পরিচালনা করছেন তিনি।
বাইশারী ইউনিয়নের নান্না তালুকদার বলেন, ‘মরিচবুনিয়ার বাসিন্দা মোস্তফার বানানো নদীর বিমানটি এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। অনেকেই বিমানটি দেখতে আসে। চড়ে ঘুরে বেড়াতে আসে। মোস্তফা গ্রামের ছেলে হলেও তার মধ্যে উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা আছে। এর আগে আরও কয়েকটি জিনিস উদ্ভাবন করেছিল, যা মানুষের খুবই উপকারী।’
কেকে/ এমএ