দেশের মোট ভোটারের মধ্যে ৩২.৬ শতাংশ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তারা আগামী নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবেন। তবে সিদ্ধান্তহীনতার এই হার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে (জেনারেশন জেড) সবচেয়ে বেশি। ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সি তরুণ ৩৬.৩৪ শতাংশ এখনো নিশ্চিত নন কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবেন। নারী ভোটারদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা গেছে ৩৭.৮৮ শতাংশ নারী ভোটার এখনো সিদ্ধান্ত নেননি তারা কাকে ভোট দেবেন।
বর্তমান সময়ে সমচেয়ে আলোচিত উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন না নারী ভোটার ৬৮.২ শতাংশ, পুরুষদের মধ্যে এ হার ৪৫.৯ শতাংশ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটাররা মুসলিম ভোটারদের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আঞ্চলিকভাবে খুলনায় ৩৫.২ শতাংশ, রংপুরে ৪০.২ শতাংশ এবং সিলেটে ৪৩.১ শতাংশ ভোটার এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।
বেসরকারি সংস্থা ইনোভিশন কনসালটিং পরিচালিত ‘পিপলস ইলেকশন পালস সার্ভে, দ্বিতীয় পর্ব- তৃতীয় খণ্ড’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত বিডিবিএল ভবনে অনুষ্ঠিত ‘ভোটারদের সিদ্ধান্তে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ভিন্নতার প্রভাব’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় জরিপের ফল প্রকাশ করে সংস্থাটি।
জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ ভোটার মনে করছেন, আগামী সরকার গঠনের জন্য বিএনপি সবচেয়ে যোগ্য দল। জরিপে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ২৩.৩ শতাংশ ভোটার মনে করেন, আগামী সরকার গঠনের জন্য দলটি যোগ্য। আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছেন ১২.১ শতাংশ। এ ছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এসসিপি) পেয়েছে ৩.৮ শতাংশ সমর্থন এবং অন্যান্য দলের জন্য রয়েছে ৫ শতাংশ সমর্থন।
এর আগে মার্চ মাসের জরিপে দেখা যায়, বিএনপির প্রতি সমর্থন ছিল ২৯.৩ শতাংশ ভোটারের। জামায়াতকে সমর্থন দিয়েছিল ১৭.৫ শতাংশ ভোটার। আওয়ামী লীগ ও এনসিপির প্রতি সমর্থন ছিল যথাক্রমে ৬.৩ ও ৩.৯ শতাংশ ভোটারের।
জরিপের ফল অনুযায়ী, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপি এগিয়ে। ময়মনসিংহ বিভাগে বিএনপি ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ, জামায়াত ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, আওয়ামী লীগ শতাংশ ১৭ দশমিক ৩ ও এনসিপি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সিলেটে বিএনপি ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ, জামায়াত ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ১৪ শতাংশ। রাজশাহীতে বিএনপি ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ, জামায়াত ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ৯ দশমিক ২ শতাংশ। খুলনায় বিএনপি ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, জামায়াত ৩০ দশমিক ১ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ঢাকায় বিএনপি ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জামায়াত ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। চট্টগ্রামে বিএনপি ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ, জামায়াত ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও আওয়ামী লীগ ১৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোটার সমর্থন পেয়েছে।
অন্যদিকে রংপুর বিভাগে জামায়াত এগিয়ে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ সমর্থন নিয়ে; যেখানে বিএনপি ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। বরিশালে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটার সমর্থন নিয়ে, বিএনপি ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ ও জামায়াত ২৯ দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের মনোভাব নিয়ে করা জরিপে উঠে এসেছে রাজনৈতিক সচেতনতা, আস্থার মাত্রা এবং ভোটের পছন্দে বড় ধরনের বৈষম্য। বিশেষ করে নারী-পুরুষ, শহর-গ্রাম, প্রজন্মভিত্তিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও উদ্বেগের পার্থক্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
জরিপে দেখা যায়, নারীদের তুলনায় পুরুষ ভোটাররা রাজনীতি বিষয়ে বেশি সচেতন এবং সক্রিয়। ১৯.৬ শতাংশ পুরুষ ভোটার মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না; সেখানে নারী ভোটারের মধ্যে এই হার মাত্র ১২.৯ শতাংশ। আবার ১৫.৫ শতাংশ নারী ভোটার ‘উত্তর দিতে অক্ষম’ বললেও পুরুষ ভোটারদের মধ্যে এই সংখ্যা ১০.২ শতাংশ।
রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে সচেতনতার ক্ষেত্রেও নারী ভোটাররা পিছিয়ে। ৬৮.২ শতাংশ নারী পিআর উচ্চকক্ষ ব্যবস্থার বিষয়ে অজ্ঞ, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এ হার ৪৫.৯ শতাংশ। তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীরাই এগিয়ে ১৯.৪ শতাংশ নারী ভোটার লিঙ্গসমতা ও বৈষম্যহীন সমাজকে দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখছেন, যা পুরুষদের মধ্যে মাত্র ৮.৪ শতাংশ।
ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ তুলনামূলকভাবে বেশি। মুসলিম ভোটারদের তুলনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ৬ শতাংশ বেশি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ৪ শতাংশ বেশি অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এটি নির্বাচনি সহিংসতা বা বৈষম্যের আশঙ্কা থেকে উৎসারিত বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নারী ভোটাররা এনসিপির সবচেয়ে বড় সমর্থনভিত্তি দলের ৫৩ শতাংশ সমর্থক নারী, যেখানে পুরুষ ভোটার ৪৭ শতাংশ। বিপরীতে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন লিঙ্গভিত্তিকভাবে প্রায় সমান। পেশাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপির প্রধান ভোটভিত্তি কৃষক ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী; অন্যদিকে এনসিপির ভোটারদের বড় অংশই শিক্ষার্থী।
বিশ্লেষকদের মতে, এই জরিপে পাওয়া তথ্যগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নির্দেশনা বহন করে। ৩৬ শতাংশের বেশি অনির্ধারিত তরুণ ভোটারদের মন জয় করাই নির্বাচনি সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হতে পারে। এজন্য গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো ও তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। নারী ভোটারদের অনিশ্চয়তা কমাতে দলগুলোর নীতি ও প্রচারণায় লিঙ্গ সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করা প্রয়োজন। ভোটের পরিবেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও আস্থা নিশ্চিত করা হবে আস্থার মূল উপাদান। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরলে দলটির জনপ্রিয়তা আরো বাড়তে পারে, ফলে এরপরে ফের জরিপ করার আহ্বান জানান এক আলোচক।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন- ড. আসিফ শাহান, জামায়াতের ড. নকিবুর রহমান, এনসিপি নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ, পলিসি এনালিস্ট ড. অনন্য রায়হান, বাংলা আউটলুকের মোকতাদির রশিদ এবং গবেষণা সংস্থা ব্রেইনের ড. শফিকুর রহমান। জরিপের প্রেজেন্টেশন দেন ইনোভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাইয়াত সারওয়ার।
কেকে/ এমএস