দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রমালিকানাধীন চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সুপারনিউমারারি পদে ৭ হাজার ২১৫ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করে সরকার। এ পদোন্নতির মাধ্যমে ব্যাংক খাতে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা ফিরে আসে।
ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিধি অনুসারে আর্থিক ও অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধা ভোগ করবেন। তা ছাড়া সুপারনিউমারারি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সহকারী মহাব্যবস্থাপকগণকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে গাড়ি ক্রয় সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তও জানানো হয়েছিল যেখানে ২০২৫ সালে অর্ধেক এবং ২০২৬ সালে অবশিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে এ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পদোন্নতির পর রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদে উন্নীত হন। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে পদোন্নতি পাওয়া ৪৭৯ জন এজিএমের মধ্যে ১১৭ জন ইতোমধ্যেই গাড়ি ক্রয়ের ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। অগ্রণী ব্যাংকে পদোন্নতি পাওয়া ২১৭ জনের মধ্যে ৪১ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। এ ছাড়া জনতা ব্যাংকে ৫৫ জন কর্মকর্তা এবং রূপালী ব্যাংকে ৩৮৫ জন কর্মকর্তা সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
কিন্তু সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এক চিঠিতে জানানো হয়, সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সহকারী মহাব্যবস্থাপকদের গাড়ি সেবা নগদায়নের জন্য গাড়ি ক্রয় ঋণ সুবিধা তাদের নিয়মিত পদে পদায়নের আগ পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।
মেধা তালিকায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে কর্মকর্তাদের চাপের মুখে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দিতে বাধ্য হয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে পদোন্নতির পরেও সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য তৈরি হওয়ায় অনেক কর্মকর্তা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাদের দাবি, এতে তারা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, বরং পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। অনেকের মতে, এই পদোন্নতির বিষয়টিকে ঘিরে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে অস্থিতিশীল করার একটি চক্রান্ত চলছে।
শান্তিনগরে একই বাসার পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন দুই বন্ধু একজন সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন, অন্যজন রূপালী ব্যাংকে। দু’জনই সুপারনিউমারারি পদোন্নতি পেয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা পদোন্নতির পর গাড়ি সুবিধা পেয়েছেন, ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন এবং ফ্ল্যাটে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। কিন্তু রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা এখনো সেই সুবিধা পাননি।
রূপালী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা ক্ষোভ ও কষ্ট প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন সমাজে আর মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। এতদিনের পর পদোন্নতি পেলাম, কিন্তু সুবিধা নেই। মনে হয় মান-সম্মানও হারিয়ে যাচ্ছে।’
ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিতদের মানবিক দিক বিবেচনা করে তারা বোর্ডের কাছে দাবি জানালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে মনে করে। পরবর্তীতে বোর্ডের অনুমোদনক্রমে এই পদোন্নতি প্রদান করা হয়, যা অভ্যুত্থান-পরবর্তী ভঙ্গুর আর্থিক খাতকে অনেকটা স্থিতিশীল করতে সহায়তা করেছে।
প্রতিবছর সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত পদোন্নতির ধারা অব্যাহত ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে সুপারনিউমারারি পদোন্নতির পক্ষে বলা হচ্ছে, নিয়মিত পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় অনেক যোগ্য কর্মকর্তা শূন্যপদ না থাকায় বা অর্গানোগ্রামে নির্ধারিত পদ না থাকায় বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন। ফলে ব্যাংক তাদের দক্ষতা ও সেবাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এই বৈষম্য দূর করতেই সুপারনিউমারারি পদোন্নতির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে আরো বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যেও সুপারনিউমারারি পদোন্নতির চর্চা রয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতেও এ ধরনের পদোন্নতি অতীতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাহলে ব্যাংকিং খাতে একই প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে আপত্তি বা অসুবিধার কারণ কী এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। বিশেষ করে যখন এই পদোন্নতি ব্যাংক খাতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি গত ৭ জুলাই উপ-সচিব আফরোজা আক্তার রিবার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করে। উক্ত প্রতিবেদনে পদোন্নতিতে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে নির্দেশনামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। অনেকে ব্যাংকে যোগদানের পর থেকে মাত্র একটি বা দুটি পদোন্নতি পেয়েছেন। এমনকি যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারাও কমপক্ষে সাত থেকে আট বছর একই পদে স্থবির হয়ে ছিলেন। এই পদোন্নতি বঞ্চিতদের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ কর্মকর্তা টানা দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই পদে কর্মরত। বর্তমানে এদের মধ্যে একটি বড় অংশ সিনিয়র পর্যায়ে রয়েছেন, যাদের চাকরি জীবনের অবসরের সময়সীমা হাতে মাত্র কয়েক মাস।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতেও সুপারনিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতির দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়টি জানিয়ে এসব ব্যাংকের পর্ষদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কেবল কৃষি ব্যাংকেই ইতোমধ্যে এক হাজার ৪০০ জন কর্মকর্তাকে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, একটি প্রভাবশালী চক্র বিশেষত কিছু আমলা ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করছে। তাদের প্রভাবিত করার ফলেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৩০ জুলাই ২০২৫ তারিখে পরিচালক-৬ (প্রতিকল্প) মো. মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইতোমধ্যেই সমাধান হওয়া ইস্যুকে পুনরায় সামনে এনে মানবিক বিবেচনায় দেওয়া পদোন্নতিকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চলছে। অথচ কিছুদিন আগেই প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবসর বাতিল করে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান এবং তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা বহাল রাখার নজির রয়েছে।
এ ছাড়া ২০২২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত একটি আদেশেও উল্লেখ রয়েছে যে, সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মতোই সব সুবিধা পাবেন। তদুপরি, তারা পরবর্তী পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নিয়মিত নীতিমালার আওতায় বিবেচিত হবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব শেখ ফরিদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা আছে। পদোন্নতিতে অনিয়ম করা হয়েছে, আর যেন এ ধরনের অনিয়ম না ঘটে সে জন্যই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
অগ্রণী ব্যাংক পিএলপির পরিচালক সুলতান মাহমুদ বলেন, অফিসারদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাদের দাবি মানার। অফিসে আমার প্রথম দিন ছিল। আমি সব জানিও না তবে বলেছিলাম যদি ন্যায্য দাবি হয় তাহলে মানতে পারলে ভালো। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল অন্য সরকারি ব্যাংক যদি দেয় তাহলে আমরা দিব। আমাদের ইচ্ছা সরকারি সব ব্যাংকে একই নিয়ম থাকুক। যারা পায়নি পরবর্তীতে নিয়ম অনুযায়ী তারা পাবে। ব্যাংকে যারা চাকরি করেন তারাই ব্যাংকের প্রাণ। তারা ভালো ভাবে থাকুক আর ব্যাংকে ভালো রাখুক।
অগ্রণী ব্যাংক পিএলপির পরিচালক সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘অফিসারদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি তখনই দায়িত্ব নিয়েছি, সবকিছু জানতাম না। তবে বলেছিলাম, যদি দাবি ন্যায্য হয় এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে মানা ভালো। আমাদের অবস্থান ছিল—অন্য সরকারি ব্যাংক যদি এ সুবিধা দেয়, তাহলে আমরাও দেব। আমাদের ইচ্ছা, সরকারি সব ব্যাংকে একই নিয়ম অনুসৃত হোক। যারা এখনো সুবিধা পাননি, তারা পরবর্তীতে নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই পাবেন। ব্যাংকে যারা চাকরি করেন তারাই ব্যাংকের প্রাণ। তারা ভালো থাকলে ব্যাংকও ভালো থাকবে।’
কেকে/ এমএস