বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিকভাবে প্রশংসিত হয়ে আসছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে পোলিও, ধনুষ্টঙ্কার, হাম–রুবেলা, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
শিশুমৃত্যুর হার যেখানে একসময় ছিল প্রতি হাজারে ১৫১, তা কমে দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত টিকার সংকট সেই অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় অভিভাবকরা সন্তানকে টিকা দিতে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। ইপিআই কর্মসূচিতে বর্তমানে ১১টি রোগ প্রতিরোধে ৮টি টিকা দেওয়া হয়। নবজাতক থেকে ১১ মাস বয়সি শিশু, ২৩ মাস বয়সি শিশু, ১৫ বছরের কম বয়সি কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি সন্তান ধারণক্ষম নারীদের এসব টিকা দেওয়া হয়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সংকট সাময়িক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেখানে শিশুর জীবন ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এ সাময়িক সংকটও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। হাম বা ডিপথেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যাবে যদি একদিনের জন্যও টিকা অপ্রতুল থাকে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা না পেয়ে অভিভাবকদের ফিরে আসাকে শুধু সেবার ঘাটতি হিসেবে দেখলেই হবেনা এটি স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার চিত্র।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও তাই মনে করেন, এ সংকটের মূল কারণ প্রশাসনিক জটিলতা। আগে অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)–এর আওতায় পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকা কেনা হতো, যা ছিল সহজ ও সময় সাশ্রয়ী। এখন টিকা কেনা হচ্ছে রাজস্ব খাত থেকে, ফলে প্রতিটি ধাপে জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হচ্ছে। সচিব বা মন্ত্রী নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ক্রয় অনুমোদন দিতে পারেন; এর বেশি হলে যেতে হয় মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে।
এ আমলাতান্ত্রিক ধাপের ফাঁদে টিকা সংগ্রহ বিলম্বিত হচ্ছে। সংকটকে কেবল ‘সাময়িক’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটি প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে যা উদ্বেগের। টিকা কাভারেজ কমে গেলে বহু সংক্রামক রোগ ফের মাথাচাড়া দেবে। ইতোমধ্যেই দেশের কয়েকটি জেলায় পেন্টাভ্যালেন্ট ও পিসিভি টিকার অভাব দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে।
এখন জরুরি হলো দ্রুততম সময়ে এ সংকট নিরসন করা। প্রথমত, মজুত টিকা সঠিকভাবে বণ্টন করতে হবে এবং সংকটকবলিত জেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঠাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘাটতি আর না হয়। তৃতীয়ত, সরবরাহ ব্যবস্থায় জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কমাতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় জোরদার করাও অপরিহার্য।
শিশুদের ইমুইনাইজেশনের কোর যায়টাটি হলো নিয়মিত টিকাদান পরিষেবা ফলে নিয়ে অবহেলা মানে জনস্বাস্থ্যে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করা। ইপিআই কার্যক্রমে বাংলাদেশের যে অর্জন সেটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনের অচলায়তন ভাঙতে হবে। টিকা ক্রয়কে সহজ করতে হবে। প্রতিটি শিশু যাতে সময়ের মধ্যেই টিকা দান পরিষেবা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। টিকা দানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে টিকাদান পরিষেবার রুটিন কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখতে হবে।
কেকে/ এমএস