সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      
খোলাকাগজ স্পেশাল
বেসরকারি মাধ্যমে সার আমদানি
স্বচ্ছ দরপত্র ব্যবস্থাপনায় ভেঙেছে সিন্ডিকেট
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশ: রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৫:১৫ পিএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

# দরপত্রেই সরকারের সাশ্রয় ২৩৩ কোটি টাকারও বেশি
# কৃষি খাতে কমবে ভর্তুকির চাপ, সুবিধা পাবে কৃষকরা
# সিন্ডিকেট ভাঙতে নতুন নীতিমালা ও কঠোর নজরদারি


বাংলাদেশের কৃষি খাতে সার শুধু একটি উপকরণ নয়, বরং খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি। ধান, গম, ভুট্টা, সবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ফসল উৎপাদনে এর ব্যবহার অপরিহার্য। তাই প্রতি বছর সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয় বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি ও টিএসপি সার আমদানিতে। দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে এক ধরনের শক্তিশালী বেসরকারি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ছিল। তাদের প্রভাবের কারণে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে সরকারকে সার আমদানি করতে হতো। এতে সরকারের ভর্তুকির চাপ যেমন বাড়ত, তেমনি কৃষকদের উৎপাদন খরচও লাগামছাড়া হতো। 

তবে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আমদানিতে চিত্র পাল্টেছে। ২০২৪ সালে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সার সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। দরপত্র ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করায় প্রথম ধাপেই বিপুল অঙ্কের টাকার সাশ্রয় হয়েছে। দরপত্রে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে ১৯.০৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাওয়া নথি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. ইমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘বেসরকারি মাধ্যমে সার আমদানিতে স্বচ্ছ ও দক্ষতা বজায় রাখা হয়েছে। কোন সিন্ডিকেটের প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। নিয়ম অনুসরণ করে সার আমদানিতে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাউকে খুশি করার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম দামে সার আমদানি সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কৃষি খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

তিনি আরো বলেন, সারা দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার মজুদ রয়েছে। কোনো ঘাটতির আশঙ্কা নেই। তারপরও কোনো কোনো মহল থেকে সার সংকটের ধোঁয়া তুলে অপপ্রচার করা হচ্ছে। বরং দরপত্রের প্রতিযোগিতায় এবার বড় অঙ্কের সাশ্রয় হয়েছে। এর সুফল সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছাবে। সিন্ডিকেট ভাঙার কারণে অনেকেই অসন্তুষ্ট হতে পারে এবং বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। কৃষককে বাঁচানো ও সরকারি অর্থ সাশ্রয় করাই সরকারের মূল লক্ষ ও উদ্দেশ্য। 

প্রতিযোগিতায় বড় সাশ্রয় : কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ সূত্র বলছে, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম দামে সার আমদানি সম্ভব হয়েছে। ফলে সরকারের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ডিএপি সার আমদানিতে সর্বোচ্চ সাশ্রয় হয়েছে। জর্ডান, মিশর ও চীন থেকে আনা প্রতিটি লটে বাজার দরের চেয়ে গড়ে ১১ থেকে ৫৫ ডলার কমে চুক্তি হয়েছে। শুধু এই সারেই সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ১৩.৫০ মিলিয়ন ডলার। টিএসপি সারেও উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় হয়েছে। মরক্কো ও লেবানন থেকে আমদানিকৃত টিএসপির দর বাজারমূল্যের তুলনায় ৩৪ থেকে ১০৭ ডলার কমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মোট সাশ্রয় দাঁড়িয়েছে ৫.২৮ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া এমওপি সার আমদানিতেও প্রতিযোগিতার সুফল মিলেছে। যদিও তুলনামূলকভাবে চাহিদা কম, তবে রাশিয়া থেকে প্রতি মেট্রিক টনে প্রায় ৩ ডলার কম দরে আমদানি সম্ভব হয়েছে। এতে সাশ্রয় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর মধ্যে ডিএপি সার ১৩.৫০ মিলিয়ন ডলার, টিএসপি সার ৫.২৮ মিলিয়ন ডলার, এমওপি সার ০.২৭ মিলিয়ন ডলার। যার মোট সাশ্রয় ১৯.০৫৫ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা)। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ডায়ামোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি বাংলাদেশের কৃষিতে জরুরি সার। ধান ও সবজিতে এর ব্যবহার বাড়ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবের তুলনায় সরকার কার্যাদেশ দিয়েছে জর্দান, মিশর ও চীন থেকে আনার জন্য। আমদানিযোগ্য সার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দেশভিত্তিক দর, দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ও কার্যাদেশ প্রদত্ত দর বিস্তর ফারাক। মিউরেট অব পটাশ বা এমওপি সারের চাহিদা বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম হলেও বিশেষ কিছু ফসল উৎপাদনে এটি অপরিহার্য। এ সাশ্রয়ের ফলে ভর্তুকির চাপ অনেকাংশে কমবে। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিতে ব্যয় হয়। ব্যয় কমাতে পারলে কৃষির অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সারদাম সবসময় অস্থির। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে কম দামে সার আমদানির উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার হবে।’

এদিকে ময়মনসিংহের কৃষক আব্দুল হাকিম বলেন, ‘এখন চাষাবাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যদি সরকার কম দামে সার আনতে পারে, তবে আমরা মাঠে স্বস্তি পাব। উৎপাদন খরচ কমলে ফসলের দামও সাশ্রয়ী হবে।’

খুলনার কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা সব সময় চাই সরকারের সরবরাহকৃত সারের ওপর নির্ভর করতে। বেসরকারি বাজারে অনেক সময় বেশি দামে কিনতে হয়। সরকার যদি কম খরচে সার আনতে পারে, তবে আমাদেরও সুবিধা হবে।’

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি : অতীতে সার আমদানিতে নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। কখনো গুদামে পৌঁছানোর আগেই সার উধাও হয়েছে, আবার কখনো টনপ্রতি অতিরিক্ত কয়েক ডলার গুনতে হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি ক্রয়প্রক্রিয়া অনেকটাই স্বচ্ছ হয়েছে। এই বছর প্রতিটি লটে দরপত্র প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সারের আন্তর্জাতিক বাজারদর নির্ধারণে বিশ্বস্বীকৃত বুলেটিন ‘আর্গুস’ ও ‘ফার্টিকন’-এর তালিকা অনুসরণ করা হয়। এতে ভিন্ন দেশের উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ব্যয়ের কারণে কিছু পার্থক্য থাকলেও কাউকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সাশ্রয় নিয়মিত হলে কৃষি বাজেটে বড় স্বস্তি আসবে। ভবিষ্যতে ইউরিয়া সারের ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া চালু থাকলে সরকারের ব্যয় আরও কমতে পারে।

ডিলারদের এক ছাতার নিচে আনা হচ্ছে : কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সার সরবরাহে নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য— কোনো গোষ্ঠীর কাছে দেশের কৃষি খাত জিম্মি না থাকা। এজন্য ডিলারের সংখ্যা বাড়ানো হবে, অনিয়ম করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

বর্তমানে দেশে ১০ হাজার ৮১৪টি ডিলারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, আর কোনো সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার সুযোগ থাকবে না। দরপ্রস্তাবের ভিত্তিতে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকেই কার্যাদেশ দেওয়া হবে। চলতি বছর ১৯ আগস্ট প্রথম ধাপে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন সার সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬ প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে সার নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। ভর্তুকির হাজার কোটি টাকার সার চলে গেছে মাফিয়াদের পকেটে। এমনকি বিসিআইসি আমদানি করা প্রায় ৭২ হাজার টন ইউরিয়া জাহাজ থেকে খালাস হলেও গুদামে পৌঁছেনি। তারপরও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

তিনি যোগ করেন, ‘এখন যদি স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং দক্ষ দরপত্র প্রক্রিয়া বজায় রাখা যায়। তবে বাংলাদেশ কেবল খাদ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, কৃষিপণ্য রপ্তানিতেও লাভবান হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার আমদানিতে বেসরকারি অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করায় সরকারের সাশ্রয় হয়েছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এটি যেমন ভর্তুকির চাপ কমাবে, তেমনি কৃষকের উৎপাদন খরচও কমবে। এ উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং কৃষি বাজেটে স্বস্তি আনবে। সরকার যদি এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে, তবে ভবিষ্যতে কৃষি শুধু দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নয়, অর্থনীতিরও প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে বলে বাংলাদেশের বাংলাদেশের কৃষকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

কেকে/এজে
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাক ভাড়া করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত তারা
শিশু বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার
১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ

সর্বাধিক পঠিত

আসছে নাটক ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’
চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
পাল্লা বাজারে রক্তলাল শাপলার মনভোলানো সমাহার
কালাইয়ে বিএনপির গণমিছিল ও লিফলেট বিতরণ
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close