বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। গত শুক্রবার রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত টানা সাত ঘণ্টা টেকনাফের সীমান্তের ওপারে শুরু হয় গোলাগুলি। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ধারণা করা হচ্ছে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ বিরতির পর হঠাৎ এমন গোলাগুলিতে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো গুলি এসে পড়েনি। তবু নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা ভয়ে তীরে ফিরে আসে। এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করে ফেরার পথে নাইক্ষ্যংদিয়া নামক স্থান থেকে মাছ ধরার ট্রলারসহ ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। ট্রলারটি সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ডেইলপাড়া এলাকার স্থানীয় জেলে সুলতান মাঝির বলে জানা গেছে।
শনিবার দুপুরে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন-২ বিজিবির আওতাধীন শাহপরীর দ্বীপ বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বি আর এম-৩ থেকে আনুমানিক ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জলসীমা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।
অপহৃত জেলেরা হলেন মো. আলি আহমদ, মোহাম্মদ আমিন, ফজল করিম, কেফায়েত উল্লাহ, সাইফুল ইসলাম, সাদ্দাম হোসেন, মো. রাসেল, মো. সোয়াইব, আরিফ উল্লাহ, মোহাম্মদ মোস্তাক, নুরুল আমিন ও একজন বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে নতুন করে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ (আরআইআর) কয়েকটি গোষ্ঠী। তাতে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মংডুটাউনশিপের কাছাকাছি নাফ নদের তীরে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। নাফ নদ অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা টেকনাফে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটকও হচ্ছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার টেকনাফ বিজিবি নাফ নদে ৬২ রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছে জানিয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ওপারে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদে ও স্থলসীমান্তে বিজিবি তৎপর রয়েছে।
বিজিবির অধিনায়ক বলেন, ‘কিছু লোক সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। যেসব পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে, সেখানে বিজিবির টহল বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
রাখাইন রাজ্যে গোলাগুলির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্তে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। পাশাপাশি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থল-জলপথে বিজিবি-কোস্টগার্ড শক্ত অবস্থানে রয়েছে।’
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদের ওপারে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে গোলাগুলি শুরু হয়। থেমে থেমে সেই গোলাগুলি গতকাল শনিবার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলতে থাকে। ওপারের গুলির শব্দ এপারের (হোয়াইক্যং) লোকজন শুনতে পেয়েছেন।
এর আগে ১৯ আগস্ট রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের ‘নারকেল বাগিচা’ এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আরাকান আর্মির দখলে থাকা দুটি সীমান্তচৌকির দখলে নিতে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এ হামলা চালায় বলে জানা গেছে। তার ১০ দিন আগেও একই এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল।
শুক্রবার রাতে ওপারের গুলির শব্দ শুনতে পান টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরীও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে শনিবার ভোররাত ৫টা পর্যন্ত টানা ৭ ঘণ্টা সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চলেছে। তাতে নাফ নদে মাছ শিকারে নামা বাংলাদেশি জেলে ও হোয়াইক্যং সীমান্ত জনপদের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে ওপারের গুলি এপারে এসে পড়েনি। নাফ নদে বিজিবির টহল রয়েছে।
সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালে টানা ১১ মাস হোয়াইক্যং সীমান্তের মানুষ ওপারের মর্টারশেলের বিকট শব্দ শুনেছেন। এরপর টানা সাত-আট মাস এপারের মানুষ গোলার শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু হঠাৎ করে গতকাল রাতে ওপারের গোলাগুলির শব্দে টেকনাফের বাসিন্দাদের ঘুম ভেঙে যায়, অনেকে হতচকিত হয়ে পড়েন।
বিজিবি ও পুলিশ জানায়, ১১ আগস্ট আরাকান আর্মির একজন সদস্য একটি একে-৪৭ রাইফেল ও ৫২ রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগাজিন নিয়ে বাংলাদেশের উখিয়ায় পালিয়ে এসে বিজিবি সদস্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তার নাম জীবন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বিজিবির হেফাজতে আছেন। জীবন তঞ্চঙ্গ্যা নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন। ১৭ আগস্ট দুপুরে বিজিবি সদস্যরা তুমব্রু সীমান্ত থেকে আরকান আর্মির সহযোগী আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসরুল হক বলেন, এ পর্যন্ত বিজিবি পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশে হস্তান্তর করেছে। তাদের মধ্যে তিনজন মিয়ানমারের নাগরিক, দুজন বাংলাদেশি। সবাই বান্দরবান কারাগারে রয়েছেন।
কেকে/ এমএস