চায়ের রাজ্যখ্যাত পর্যটন নগরী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে কয়েকটি প্রাচীন গিরিখাত। এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ ‘লাসুবন গিরিখাত’।
লাসুবন গিরিখাত উপজেলার ৪নং সিন্দুরখান ইউনিয়নের ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী নাহার চা-বাগানের খাসিয়া পুঞ্জির গভীর পাহাড়ি অরণ্যে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য এই গিরিখাতটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গিরিখাতের দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটার থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেকের ধারণা, এসব গিরিখাত ভূতাত্ত্বিকভাবে হাজার বছরের প্রাকৃতিক ক্ষয়প্রক্রিয়ার ফল। করোনাকালে এসব প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান মিললেও দুর্গম পথ এবং জনসমাগমের অভাবে এ স্পটগুলো এতোদিন অপরিচিত ছিল।
জানা যায়, স্থানীয় আদিবাসীরা গিরিখাতগুলোর নাম দিয়েছেন লাসুবন, ক্রেম উল্কা, ক্রেম কেরি ইত্যাদি। লাসুবন নামের অর্থ হলো পাহাড়ি ফুল। এসব নামকরণ হয়েছে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, আশপাশের গাছপালা, ফুল-ফল এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে স্থানীয় নাহার খাসিয়া পুঞ্জির অভ্যন্তরে গিরিখাত এলাকাটির অবস্থান। লাংগুলিয়া ছড়া নামের একটি পাহাড়ি ছড়া ধরে পুরো এলাকাটি ঘুরে আসা যায়। যেটি ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ছড়াটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মিশেছে শ্রীমঙ্গলের বিলাস ছড়ায়। সর্পিল বাঁক নিয়ে চলা ছড়র সাথে মিশেছে আরো প্রায় শ’খানেক ছোট-বড় পাথুরে ছড়। এর মধ্যে কয়েকটি গিরিখাত রয়েছে। পাহাড় থেকে ৫০০ মিটার নিচে এসব গিরিখাত কোথাও আকারে প্রশস্ত (চ্যাপ্টা) আবার কোথাও সরু। ফলে একেবারে নিচের বা ভেতরের অংশে সূর্যের আলো পৌঁছানোর সুযোগ নেই।
প্রাচীন এই গিরিখাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রাকৃতিক পাথুরে ছড়া বা ঝিরি। এখানে ক্রেম ক্লু, ক্রেম কেরি এবং ক্রেম উল্কা নামে পরিচিত তিনটি বড় গিরিখাত রয়েছে। এগুলোতে অভিযানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও প্রকৃতির বুকে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা নিরাপদে ভ্রমণ করা সম্ভব হলেও বর্ষায় পানির স্রোত বিপদজনক হয়ে ওঠে। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বেশি থাকে পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে আসা এসব ছোট ঝিরিগুলোতে। এছাড়া কিছু জায়গায় খাড়া পাথরের দেয়াল থাকায় পা পিছলে যাওয়া বা দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। গিরিখাতের চারপাশে রয়েছে গভীর গুহা, ছোট ছোট জলপ্রপাত, পাহাড়ি ঝর্ণা। সব মিলিয়ে প্রকৃতি এই অঞ্চলকে দিয়েছে এক রহস্যময় ও মনোমুগ্ধকর রূপ।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইসলাম উদ্দিনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা গিরিখাতটি পরিদর্শন করেছেন। গত ৭ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন ‘ডিসি মৌলভীবাজার’ এর ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টের মাধ্যমে প্রাচীন গিরিখাত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের অফিসিয়াল ফেসবুক আইডিতে ডিসি লিখেছেন, শ্রীমঙ্গলের নাহারপুঞ্জির নিকটস্থ লা-সুবহান (লাসুবন) গিরিখাত ভ্রমণ করলাম। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্থান ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হতে পারে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
শ্রীমঙ্গল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিষয়ক উপজেলা সমন্বয়কারী তাজুল ইসলাম জাবেদ জানান, ২০০০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা নিয়ে কাজ করার সময় আমরা কয়েকজন প্রথমে এই প্রাচীন গিরিখাতগুলোর সন্ধান পেয়ে উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করি। পরে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী এলাকাটি পরিদর্শন করেন।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব গিরিখাত সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা গেলে শ্রীমঙ্গলের পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। চা-বাগান, লেক, ঝর্ণা ও বনাঞ্চল ঘেরা এই পাহাড়ি গিরিখাতগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য হবে অনন্য রোমাঞ্চকর গন্তব্য।
স্থানীয়রা বলেন, শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন গিরিখাতসমূহ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। যথাযথ সংরক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, গিরিখাতগুলোতে যাতায়াতের জন্য সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। একটি ব্রিজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, বাকি ব্রিজগুলো দ্রুত সময়ে নির্মাণ করা হবে। গিরিখাতগুলো দুর্গম এলাকা হওয়ায় পর্যটকদের অভিজ্ঞ গাইড সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের পরামর্শ দিয়েছেন ইউএনও।
লাসুবন গিরিখাতে যেতে হলে প্রথমে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে জিপ বা মোটরসাইকেল নিয়ে সিন্দুরখান যেতে হবে। এখানে পৌঁছে হরিণছড়া চা বাগানের কাছে গিয়ে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে লাসুবনের পথ। চাইলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে গাইড হিসেবে। তারপর হেঁটে কয়েক কিলোমিটার যেতে হয়। এই হাঁটার পথটি পুরোটাই পাহাড়ি ছড়া ও খাড়া পাহাড়-টিলাবেষ্টিত। এ এলাকা মূলত সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে বসবাস করেন খাসিয়া ও চা বাগান শ্রমিক ও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষজন।
কেকে/ এমএস