মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রজায়ায় আজ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে বিভিন্ন সমঝোতা স্মারকের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, শিগগিরই স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন। এবারের আলোচনায় কর্মীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকার প্রধান একমত হয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া দুই দেশের অংশীদারিত্ব গভীর করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন দুই দেশের সরকারপ্রধান।
মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে পুত্রজায়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে দুই দফায় সভা হয়েছে। ওইসব সভা থেকে শ্রমিক প্রেরণের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে বিদ্যমান আইন ও বিধি মেনে মালয়েশিয়ায় কর্মী গমন করলেও উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের কারণে প্রক্রিয়াটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বিগত সরকার বিপুল সংখ্যক এজেন্সিকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার কারণে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যায়। তবে কর্মীরা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর প্রায় সবাই কাজ পেয়েছে এবং তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছে। ফলে মালয়েশিয়া যাওয়া শ্রমিকদের কোনো অভিযোগ নেই। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ১ হাজার ৭০০ রিঙ্গিত। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় মালয়েশিয়ায় যেতে বাংলাদেশি কর্মীদের আগ্রহ বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মঙ্গলবার দুই দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠকটি আশার আলো জাগিয়েছে। এবারের আলোচনায় কর্মী এবং দেশের স্বার্থে শ্রমিকের সুরক্ষা ও নিরাপদ এবং স্বল্প ব্যয়ে লাভজনক কাজ নিয়োগের বিষয়ের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে যখনই দু’দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়ায় গমনের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই দেশে জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু এজেন্সি আন্দোলন, মানববন্ধন, গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে সম্ভাবনাময় অভিবাসন প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দু’দেশের সরকারপ্রধান অভিবাসন প্রক্রিয়াটিকে কর্মীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক অভিবাসন বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিষয়ে একমত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আগামী ৬ বছরে মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ১২ লাখ বা তারও বেশি শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দুদেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আলাপ-আলোচনার পর কেটে যাবে সব জটিলতা। শিগগিরই বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আবার খুলে যাবে মালয়েশিয়ার বাজার। তাই মুহূর্তে সরকার শ্রমিকদের স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে নিরাপদ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে।
মালয়েশিয়ানদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান ড. ইউনূসের
বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে আরো ব্যবসাবান্ধব করতে ইতোমধ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গতকাল কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে আয়োজিত এক ব্যবসা ফোরামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অতীতে বাংলাদেশে ব্যবসা প্রত্যাশামতো অগ্রসর হয়নি। তবে নতুন বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যবসার সম্ভাবনা। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবসাবান্ধব করতে কাজ চলছে এবং পরিবর্তিত বাংলাদেশে তিনি অসীম সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন। বাংলাদেশ তরুণদের দেশ, সৃজনশীল মানুষের দেশ, উল্লেখ করে তিনি বিনিয়োগকারীদের বহু দেশে ছড়িয়ে থাকা তরুণ বাংলাদেশি প্রবাসীদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। প্রবাসী তরুণ বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের সবসময়ই বাংলাদেশের জন্য কিছু করার তীব্র ইচ্ছা রয়েছে।
ব্যবসায়িক এ সমাবেশের আগে মঙ্গলবার পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
পাঁচটি সমঝোতা স্মারক, তিনটি নোট বিনিময় স্বাক্ষর
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তিন দিনের মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম কুয়ালালামপুরের পুত্রজায়ায় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এমওইউ ও নোট বিনিময় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন।
প্রথম নোট বিনিময়টি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। দ্বিতীয় নোট বিনিময়টি কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে প্রথম এমওইউটি হয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে। দ্বিতীয় এমওইউটি হলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ, এলএনজি অবকাঠামো, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ে। তৃতীয় নোট বিনিময়টি হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতা বিষয়ে। তৃতীয় এমওইউটি মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। চতুর্থ এমওইউটি মালয়েশিয়ার মাইমস সার্ভিসেস এসডিএন. বিএইচডি. (এমএসএসবি) এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই)-এর মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। পঞ্চম এমওইউটি মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের এফবিসিসিআইয়ের মধ্যে স্বাক্ষর হয়।
অংশীদারিত্ব গভীর করার অঙ্গীকার
সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। এ সময় উভয়ে দুদেশের সম্পর্ককে আরো গভীর এবং কৌশলগত ভবিষ্যতমুখী অংশীদারিত্বে রূপান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রথমে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন। এর আগে সীমিত সংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জনশক্তি ও জ্বালানি সহযোগিতা, নীল অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিস্তৃত পরিসরের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করেন।
প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহানুভূতির ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবসম্পদ, বাণিজ্য ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অনন্য অংশীদার।’
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অধ্যাপক ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা এবং গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ, শিক্ষা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ
এদিকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সকালে মালয়েশিরার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে।
কেকে/ এমএস