২০২৪ সালের ৩০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে এক প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঘোষণা অনুযায়ী, ৩১ জুলাই সারা দেশে আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পালিত হয়। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মুখ ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করার প্রতিবাদ চালানো হয়। এ প্রতীকী প্রতিবাদে শরিক হন দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা গণহত্যা, গণগ্রেফতার, গুম, খুন ও দমনপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের তদন্ত দাবি করেন। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার এ ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচির আহ্বান করে জানান, এটি নিপীড়নের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদেরই এক রূপ।
রাষ্ট্রীয় শোক বনাম লাল প্রতিবাদ : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে সরকার ৩০ জুলাই এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেন, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন হয়। এ উদ্যোগ যতটা আনুষ্ঠানিক, ততটাই প্রতীকী এবং আন্দোলনকারী ছাত্রদের কাছে পরিত্যাজ্য। তাই তারা রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ : শিক্ষার্থীদের হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেন। রাজধানীর গুলিস্তানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদী গানের মিছিলে পুলিশের বাধা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। এদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোট পুরানা পল্টনে আয়োজিত সমাবেশে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান হুঁশিয়ার করে বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কসহ আটক সবাইকে মুক্তি না দিলে আন্দোলন আরো কঠোর হবে।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ : জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ জাতিসংঘ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছি।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল এক বিবৃতিতে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ জানান। একইসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে খোলাচিঠিতে বাংলাদেশে দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তোলেন।
সরকারি প্রতিক্রিয়া তদন্তের আহ্বান ও হাসপাতাল পরিদর্শন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ‘ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দোষীদের শাস্তি হোক এটাই আমি চাই।’ তিনি আহতদের দেখতে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ঘোষণা দেন, জননিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে এবং ইন্টারনেট সচল থাকায় অনলাইনে ক্লাস চালুর বিষয়ও বিবেচনায় রয়েছে।
মামলার পরিসংখ্যান ও গ্রেফতার : কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ঢাকায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৬৪টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৩টি হত্যা মামলা। গ্রেফতার হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ জন, সারা দেশে এ সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার। ডিবি হেফাজতে পাঁচ দিন ধরে আটক রাখা হয়েছে ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে। সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র মুখ বন্ধ রেখে অবস্থান নিতে চাইলে তাদের বাধা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গ ও রাজনৈতিক বিতর্ক : সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনপীড়নের অভিযোগের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ সামনে আসে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেন, ‘গণহত্যাকে আড়াল করতেই সরকার জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ সামনে এনেছে।’
প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা : সহিংসতা ও নাশকতা প্রতিরোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘সন্ত্রাস ও নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেয়।
কেকে/ এমএস